না’গঞ্জে ভিক্ষুকের বয়স্কভাতার টাকা ছাত্রলীগ নেতার পকেটে!

আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২২
0

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ : টাকার লোভ সামলাতে না পেরে মানুষ যে কতটা অমানুষ কিংবা মনুষ্যত্বহীন হতে পারে তা বলা বাহুল্য। তেমনী এক মানুষরুপী মনুষ্যত্বহীনের পরিচয় পাওয়া গেলো যিনি ভিক্ষুকের বয়স্কভাতার টাকা খাচ্ছেন প্রায় এক বছর যাবত। সেই মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তিটি হলেন, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মো. সজীব আহমেদ। সে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা এবং ওয়ার্ড মেম্বার ভাতিজা। যার বিরুদ্ধে বয়স্ক নারীর বয়স্কভাতার এক বছরের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, কুতুবপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মৃত্যু সুরুত আলী খা’র ৮৪ বছরের বয়স্কা স্ত্রী নূরজাহানের এক বছরের বেশি সময় ধরে বয়স্ক ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে খাচ্ছে কুতুবপুর ইউপির ৬নং ওয়ার্ডের রোকন উদ্দিন মেম্বার ও ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দীনের ভাতিজা, মহিউদ্দীন ওরফে চোর মহির ছেলে মোঃ সজীব আহমেদ। এক চাচা কুতুবপুর ইউপির আওয়ামী লীগের সভাপতি অন্য চাচা কুতুবপুর ইউপি মেম্বার হওয়ায় এবং বড় দুই ভাই জেলা ছাত্রলীগের নেতা হওয়ায় একাধিক অপকর্ম করে যাচ্ছে সজীব। চাচা ও ভাইদের কারনে নিজেও জেলা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক পদ ভাগিয়ে নেন। জেলা ছাত্রলীগের পদ ও পরিবারের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সজীব কুতুবপুর ইউপির বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছে। তারই এক প্রমান পাওয়া গেছে এক বয়স্ক মহিলার বয়স্ক ভাতা আত্মসাৎ করার। এছাড়াও সজীব আরো অনেকের বয়স্কভাতার টাকা আত্মসাৎ করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত বছর সরকারি নির্দেশ মোতাবেক বয়স্কভাতা প্রাপ্তদের নগদের মাধ্যমে একাউন্ট করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক বয়স্কভাতা প্রাপ্তদের মোবাইলে টাকা পাঠানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত বছর নগদের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে অনেকের নগদ একাউন্ট খুলে দেন এই সজীব। তখন থেকে অনেকেরই টাকা তার ব্যক্তিগত নাম্বারে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৬নং ওয়ার্ডের এমন অনেক বয়স্কা আছে যারা এক বছর আগেও হাতে হাতে টাকা পেলেও গত এক বছর ধরে কোন টাকা পাচ্ছে না।
বয়স্কা নূরজাহান বেগম জানায়, আমি নূরজাহান আমার স্বামী সুরুত আলী খা। আমি কুতুবপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পাগলার ভোটার। আমার বয়স্ক ভাতার টাকা আগে হাতে হাতে দিছে পাইছি। এখন মোবাইলে টাকা দেয় এক বছর ধরে এক টাকাও পাই না। আমি উপজেলায় গেছি। উপজেলার স্যার আমারে জিজ্ঞাসা করছে আমি কতদিন ধরে টাকা পাই না। আমি বলছি আমি এক বছর ধরে টাকা পাই না। তারপর আমার থেকে বই নিয়ে কম্পিউটারে দেখছে। দেইখা বলছে (০১৯৬২-৮২৮৩৭০) এই নাম্বারে টাকা যায় কে টাকা খায় আপনার পোলা মাইয়ারে বলেন খুঁজে বের করতে।

তিনি আরো বলেন, গতবছর আমারে সিম কিনতে কইছিলো আমি ভূইঘর গিয়া নগদের সিম কিনছিলাম কিন্তু সেই সিমে এক বছর ধইরা কোন টাকা আসে নাই। আমি গরীব মানুষ। মাইনসের কাছ থাইক্কা খুঁইজা খাই। এক বছর ধইরা মাইনসের মোবাইলে টাকা চইলা যায়। আমি এক টাকাও পাই না। ওনহান (উপজেলা) থাইক্কা তিন চারটা ওই নাম্বারে কল দিছে খালি কল কাইট্টা যায় । এইহানে ফোনের দোকানে দেখাইছি কার নাম্বার হেরে সবাই চিনে। আমি গরীব মানুষ। আমার তো কেউ নাই। মাইনসের হাত পা ধইরা একটা বই করছিলাম আমি বুড়া মানুষ একটু চইলা ফেররা খামু। এহন খামু কি আমি তো গোরস্থানে যাই। আমি গরীব মানুষ কষ্ট কইরা কেমনে চলি। আমার বইয়ের টাহা এক টাহাও পাই না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই আমার বইয়ের টাকা কেমনে মাইরা খায় তার বিচার হোক।
নূরজাহানের টাকা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মোঃ সজীব খাচ্ছে কিনা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে যাচাই করতে গেলে দেখা যায় গত এক বছরে সজীবের নাম্বারে ৩ বার নূরজাহানের টাকা গেছে। যেই নাম্বার ইমুতে সজীবের নাম ও ছবি দিয়ে সংরক্ষণ করা।
নূরজাহানের টাকা আত্মসাৎ এর বিষয়টি জানতে পেরে সমাজসেবা কর্মকর্তা রুহুল আমিন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এমন অনেক গুলোই অভিযোগ আমরা পেয়েছি। কারন গত বছর থেকে আমরা বয়স্কভাতা নগদের মাধ্যমে মোবাইলে পৌঁছে দিচ্ছি। সরকার থেকে নির্দেশ এসেছে যাদের বয়স্কভাতা আছে তাদের মোবাইলে টাকা পৌঁছে দেবার। তবে এই ক্ষেত্রে অনেকে আছেন যারা বয়স্ক বা মোবাইল সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের ক্ষেত্রেই আমরা এই ধরণের সমস্যা পেয়েছি। হয়তো তার নগদ একাউন্ট তার ছেলে, মেয়ে, প্রতিবেশী বা আগে ইউনিয়ন থেকে বয়স্কভাতা যার ফোন নাম্বার ব্যবহার হয়েছে তার নাম্বারে করা। এক্ষেত্রে অনেকের টাকা অন্য কারো কাছে চলে যাচ্ছে। নূরজাহানের বয়স্ক ভাতা বহিতে আমাদেরকে যেই নাম্বার দেওয়া হয়েছে আমরা সেই নাম্বারে টাকা পাঠাচ্ছি এটা হতে পারে।
সমাজসেবা অফিসের অফিস সহকারী মামুন জানায়, বয়স্কভাতা যার সে যদি আমাদের অফিসে এসে বলে এই নাম্বার উনার না এবং উনার নাম্বার দেয় তাহলে আমরা আগের নাম্বার সরিয়ে নতুন নাম্বার সংযুক্ত করে দিতে পারবো।
অন্যদিকে বয়স্কভাতার টাকা আত্মসাৎকারী মোঃ সজীব আহমেদ প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ভাই আমিতো অনেকের উপকার করেছি কিন্তু এতো হতে পারেনা। উক্ত নাম্বারটিতে ফোন দেয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আবার ইমুতে কল দেয়া হলে আপনার ছবিসহ ভেসে আসছে তাহলে এর রহস্য কি জানতে চাইলে, পরে টাকা নেবার কথা স্বীকার করে বলেন, ভাই আমি ঐ সিমটি অনেকদিন যাবত ব্যবহার করিনা। যদি ঐ মহিলার টাকা আমার মোবাইলে এসে থাকে তাহলে আমি তার টাকা তার কাছে ফিরিয়ে দিবো। আপনে মহিলার ঠিকানা আমাকে দেন আমার একাউন্টে যত টাকা আসছে আমি দিয়ে দিবো। সজীব আরো বলেন, ভাই এ বিষয়ে কোন নিউজ কইরেন না, যদি নিউজ করেন তাহলে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।
বয়স্কভাতা আত্মসাৎকারীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা এ বিষয়টি কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে জানাতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কলটি রিসিভ করেননি।
কুতুবপুর ইউপির ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার রোকন উদ্দিন (ছাত্রলীগ নেতার চাচা) নুরজাহানের বয়স্কভাতা আত্মসাৎ করার বিষয়ে বলেন, আমি তো এবিষয়ে জানি না। আপনে আসেন সজীবকে সরাসরি রেখে আমি জিজ্ঞাসা করবো কিভাবে এই কাজটি সে করলো। যদি সজীব সত্যিই এই ধরনের কাজ করেন তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিবো।
জেলা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক হয়ে কিভাবে একজন অসহায় নারীর বয়স্কভাতা আত্মসাৎ করে সজীব এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আজিজুর রহমান আজিজের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সাধারণ সম্পাদককে ফোন দিলে তিনি সজীব নামে জেলা ছাত্রলীগে কেউ নাই বলে জানান এবং সংবাদ মাধ্যমের কোথাও ভূল হচ্ছে বলে এড়িয়ে যান বিষয়টি।