পটুয়াখালীতে এলজিইডি প্রকল্পের কাজ কাগজে আছে,বাস্তবে কলমে নেই

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২
0

মু,হেলাল আহম্মেদ(রিপন)
পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ

পটুয়াখালী’র এলজিইডিতে কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির আতুরঘড়ে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের কাজ কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। নিয়ম-নীতির বালাই নেই দরপত্র আহ্বানেও। নির্বাহী প্রকৌশলীসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ঠিকাদার সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে । কাজের মান তো দূরের কথা, কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের কোনো হদিসই নেই। প্রধান প্রকৌশলী বরাবর দেওয়া কয়েক ঠিকাদারের অভিযোগের ভিত্তিতে আইবি আরপি প্রকল্পের ৪টি নোটিশের ৩২টি ব্রিজের দুর্নীতি খুঁজতে প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক গঠিত ৩ সদস্যর কমিটি গঠন।

এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর কাছে দেওয়া অভিযোগ, তদন্ত কমিটির সঙ্গে আলোচনা এবং সরেজমিন পরিদর্শন ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালী সদর উপজেলার কযেকটি গ্রামীণ সড়কের আইডি নম্বরে পটুয়াখালী শহরের ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্রয়নীতির তোয়াক্কা না করে ২০২০ এপ্রিল ও মে মাসে ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর নোটিশে ৩২টি আয়রন ও গার্ডার ব্রিজের দরপত্র আহ্বান করেন পটুয়াখালী এলজিইডির তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সত্তার বহাল তবিয়তে ছিলেন। যার নির্মাণব্যয় প্রায় ২শ কোটি টাকার ওপরে।

পটুয়াখালী পৌর শহরের দক্ষিণ পাশে উপজেলা পরিষদের খালে সেতারা ক্লিনিকের সামনে থেকে ইসহাক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় দেখানো হয়েছে ৮টি লং আরসিসি গার্ডার ব্রিজ। যার গড় দূরত্ব ৩শ ফুটের একটু বেশি। এর মধ্যে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে মাত্র ৪শ ফুট দূরত্বে সেতারা ক্লিনিকের সামনে সদর উপজেলার আরএইচডি পুকুরজানা টু বাসস্ট্যান্ড গ্রামীণ সড়কে ১৫ মিটার দীর্ঘ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ দেখানো হয়েছে, যার টেন্ডার আইডি নং-৪৪৭১৯৪। এখানে বাস্তবে ব্রিজের কোনো অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়নি।

এখানে রয়েছে পৌরসভার আরসিসি রাস্তা ও উভয় পাশে অনেক বহুতল ভবন। একই রাস্তার ওপর ২টি ১৫ মিটার দীর্ঘ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ দেখানো হলেও এসব ঠিকানায় আসলে ব্রিজের কোনো অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় নি। এর মধ্যে ৭নং ওয়ার্ডে কলাতলা এলাকার বাবরী মসজিদসংলগ্ন স্থানে ২টি ব্রিজ নির্মাণের স্থান দেখানো হয়েছে পায়রাকুঞ্জ বাজার সড়কের আইডি দেখিয়ে সেখানে উপজেলা পরিষদের রাস্তাই নেই। এটা সড়ক ও জনপথ বিভাগের পটুয়াখালী-পায়রাকুঞ্জ-মির্জাগঞ্জ-বেতাগী আঞ্চলিক মহাসড়ক। সেতারা ক্লিনিকের সামনে একই সড়কে ৪৫ মিটার দীর্ঘ আরসিসি গার্ডার ব্রিজটি দেখানো হলেও বাস্তবে এর কাজ চলছে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরত্বে মাদারবুনিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের উত্তর পাশের খালের ওপর। সোনালী বাজার ভায়া বাদুড়া জিসি রাস্তার ওপরে ১৮ মিটার ব্রিজ। এছাড়া দুটি ব্রিজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তার ওপর স্থান নির্ধারণ করা হলেও এখানে রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ২টি স্লুইস গেট। সর্বশেষ ৩৫ মিটারের ব্রিজটির নির্ধারিত স্থানে পৌরসভার অনেক পুরোনো পাকা রাস্তা থাকলেও খালের কোনো অস্তিত্বই নেই।

গরুর বাঁধ-বোতলবুনিয়া আয়লা জিসি সড়কে ৮১ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ব্রিজের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো বেড়িবাঁধের ওপর পাকা সড়ক রয়েছে। আরও আছে অনেক বড় ১টি স্লুইস গেট। এই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সুন্দর রাস্তা ও স্লুইস গেট থাকার পরও এলজিইডির টাকায় পৌর শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে প্রকল্প গ্রহণ করায় উষ্মা প্রকাশ করেন তদন্তকারী দলের প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নুর হোসেন হাওলাদার। উপজেলা পরিষদের সামনের রাস্তায় ৮১ মিটার আরেকটি আরসিসি গার্ডার ব্রিজের দরপত্র আহ্বান করা হলেও সরেজমিন এই সড়কে কোনো খাল না থাকায় কোনো ব্রিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি তদন্তদল। তবে এখান থেকে ২শ মিটার উত্তরে উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগ সড়ক হিসেবে এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো একটি বাঁধের ওপর ব্রিজটি নির্মাণ করা হবে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।

প্রকল্পের নীতিমালা তোয়াক্কা না করে গ্রামীণ জনপদের আইডি ব্যবহার করে ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকা ও ব্রিজের স্থান শহরে দেখানো, ব্রিজের স্থান, জরিপ, প্রাক্কলন তৈরি, প্রকল্প অনুমোদন ও দরপত্র আহ্বানে নানা অনিয়মের কারণে তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত হোসেন কোনো প্রাক্কলনেই স্বাক্ষর করেননি। টেন্ডার নোটিশে দেখা দেছে, ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল পটুয়াখালী এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত ৩৬ নম্বর নোটিশে ৮টি প্যাকেজে ১২টি ব্রিজ এবং ৩৭ নম্বর নোটিশে ৭টি প্যাকেজে ৭টি ব্রিজ এবং ৩৮ নম্বর নোটিশে ৫টি ব্রিজ এবং একই বছরে ৫ মে স্বাক্ষরিত ৩৯ নম্বর নোটিশে ৮টি ব্রিজ দক্ষিণাঞ্চলীয় লোহার সেতু পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান করা হয়।

এর মধ্যে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ৩৭নং নোটিশে দেখা যায়, পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডে মেয়রের শ্বশুরবাড়ি এলাকা আরামবাগের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। সেখানে খাল না থাকলেও রয়েছে তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুস সাত্তার হাওলাদারের শ্বশুরবাড়ি। বাড়ির পশ্চিম দিকে জেলখানাসংলগ্ন ড্রেনের ওপর আরও দুটি গার্ডার ব্রিজের স্থান দেখানো হয়েছে। উপজেলা পরিষদ সংযোগ সড়ক আইডি দেখানো হয়েছে সদর উপজেলার আয়লা জিসি ভায়া বোতলবুনিয়া এবং খাটাসিয়া। পৌরসভা থেকে বোতলবুনিয়া ১০-১২ কিলোমিটার, খাটাসিয়া প্রায় ২৫ কিলোমিটার ও আয়লা ২৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

এসব অনিয়মের কারণে ২১টি ব্রিজের কাজ কোনো অবস্থাতেই শুরু করা যাবে না বলে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল হাই প্রাক্কলন স্থগিত রাখার আদেশ দেন। তা সত্ত্বেও ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে ৪টি নোটিশে ৩২টি ব্রিজের কার্যাদেশ প্রদান করা হয় ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে।

নাম গোপন রাখার শর্তে এলজিইডির এক প্রকৌশলী বলেন, উপজেলা সংযোগ সড়ক, ইউনিয়ন সংযোগ সড়কের ‘এ’ অথবা ‘বি’ নির্ণয়কৃত এলাকায় প্রকারভেদে উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। গ্রামীণ সড়কের আইডি ব্যবহার করে এর আওতার বাইরে কোনো উন্নয়নই করতে পারে না এলজিইডি।

পটুয়াখালী জেলার ৮ উপজেলায় সহস্রাধিক লোহার সেতু (আয়রন ব্রিজ) রয়েছে, এর মধ্যে ৬ শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। পটুয়াখালী এলজিইিডি এসব গ্রামীণ জনপদের সড়কের ব্রিজের উন্নয়ন না করে অদৃশ্য কারণে পৌর শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

পটুয়াখালী এলজিইডিতে বিভিন্ন প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী জিএম শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি দৈনিক বাংলাদেশ কন্ঠকে বলেন, আমি যা-ই করি কাগজপত্র ঠিক রেখে কাজ করেছি।

গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (অডিট) মো. নূর হোসেন হাওলাদারের কাছে উপরোক্ত প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় জানতে চাইলে বলেন, আমরা সরেজমিন তদন্ত করেছি এবং রিপোর্ট তৈরির জন্য কাজ চলছে। তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য পটুয়াখালী জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা মাঠে বাস্তবে যা পেয়েছি তাই তদন্ত রিপোর্টে আসবে।

আইআরডিপি প্রকল্পে পটুয়াখালীতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ আলী ব্যস্ত রয়েছি বলে ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ রাখেন।

প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মহসিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পটুয়াখালী এলজিইডির কথা শুনেই ফোনে কোনো কথা বলা যাবে না বলে তিনি মোবাইল রেখে দেন।