প্রিয় অরিন :আমার ‘অরফানেজ জীবন

আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২৩
0


ডা. জাকারিয়া চৌধুরী :

আবার চোখে মুখে পানি ছিটা দিয়েছি। কড়া চা’ও খেয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্ষায় ক্লান্ত পল্লবহীন বৃক্ষের মত জবুথবু হয়ে পা তুলে চেয়ারে বসে আছি। মাথায় একটা গল্প ঘুরছে। তোমার সাথে আমার কি হয়েছে না হয়েছে ,যখন তুমি পাশে থাকো না তখন আমিও মনে রাখতে পারিনা। আমি বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি; আমার কথার ধরনে কি তাঁর লেশমাত্র আছে মনে করো ! নেই, আসলেই নেই।

একটা গল্প বলে যাই। আজকের পর আর কখনো আমার মত এত বকবক করবে না কেউ আমি নিশ্চিত। আমার ছোট বেলার কথা। এই গল্পটা আগে কখনো বলিনি, এখন মনে হচ্ছে গল্পটা লিখে সুন্দর আরেকটা খামে ভরে তোমার বালিশের নিচে রেখে যাই। রাতে ঘুমানোর সময় যখন মোবাইলটা বালিশের নিচে রাখতে যাবে তখন এই চিঠিটাও পাবে। কতটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়বে নাকি পড়বেই না, বুঝতে পারছি না। তবু রেখে যাব ঠিক করেছি। চিঠিটা তোমার জন্য কোন গুরুত্ব বহন না করলেও নীরুর কাজে লাগতে পারে। নীরু আমার মত। নিজেকে পাথর চাপা দিয়েও দিব্বি সয়ে যেতে পারে সে। সে যেমন সব সইতে পারে, অভিমানের পাথর বুকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে, আমিও তেমনি নীরুর জন্যে সব করতে পারি।

গল্পটা লিখতে গিয়ে গলা ধরে এসেছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। আমি জোর করে স্বাভাবিক থাকতে চাইছি। তবু খুব কষ্ট হচ্ছে অরিন, ভীষন কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা ফাকা ফাকা লাগছে। আমার অনেক কান্না পাচ্ছে-
‘লোকটা দিলু ফুপুর সাথে প্রেম করত, আমার মনে আছে সে খুব স্বজ্জন আর উদার ছিল। বাচ্চাদেরকে খুব ভালোবাসত। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় মেয়েরা কোন অবস্থাতেই একা দেখা করত না। সাথে একজন ছেলে শিশুকে তাদের চাই-ই চাই। ছেলেরা শিশু হলেও গার্ডিয়ান। যেহেতু বাসার বাইরে গিয়ে কেউ কারো সাথে কোথাও বসা ছিল এক প্রকার নিষিদ্ধ কাজ সেহেতু মানুষ এসবের কথা ভাবনায় আনত না। বাসায় লোক বলতে আমরা মোটে চারজন। আব্বা, বড় আপা, আমি আর সেই ফুপি। আব্বা আর আপা সকাল দশটার মধ্যেই কলেজে চলে যেত। বাসা ফাকা হবার পরই উনি সাধারনত আসতেন। তারা কথা বলত দুপুর দুইটা আড়াইটা পর্যন্ত। এই সময়টায় আমাকে ফ্লোরে বসিয়ে ছক্কা খেলায় মাতিয়ে দিত। একই রুমের ফ্লোরে বসে আমি হয়ত খেলায় ব্যাস্ত, তারা দুজন দুই খাটের কোনায় বসে অনুচ্চ স্বরে কথা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। আমি তখন মুখে মুখে থ্রি তে পড়ি ( আমার জীবনে স্কুলিং শুরু হয় ক্লাস ফোর থেকে। কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে আমার প্রথম পড়াশোনা শুরু হয়। ) ফলে আমিও মাসের পর মাস খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে, তাদের গল্প গুজব শুনে দিন পার করছি। আমি জেনে বুঝেই যেন চাইতাম, লোকটা নিয়মিত আসুক। এই ইচ্ছাটা আমার বেশি হয় নাকি ফুপির বেশি হয় আমি শিউর না। আমি নিশ্চিত ছিলাম, উনি একদিন না আসলে আমি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ব। তিনি আমাকে এতটাই স্নেহ দিয়েছেন যে, জীবনের ওই পর্যায়টাতে আমি বাবা মা বলতে তাকেই বুঝতাম। শিশুকাল থেকেই নি:সংগতা আমার নিত্য সংগী। সুতরাং দিনটা পার করার জন্যে হলেও তাকে আসতেই হবে। এমন একটা পর্যায় তখন আমি পার করেছি যাকে এখন মনে হয় আমার ‘অরফানেজ জীবন’।

আমার বড় আপা একাউন্টিংয়ে অনার্স করছে। সকালে কলেজে যায়, ফিরে চারটায়। পাচটা সময় জালাল স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যায় ফিরে রাত আটটায়। বাসায় যতক্ষন থাকে ততক্ষন ক্যাসিও ক্যালকুলেটর টিপে আর নিউজপ্রিন্ট কাগজে অংক করে যায়। মুখে কোন কথা নেই। আব্বা দুপুরের পর বাসায় ফিরে। তার আগে থেকেই প্রাইভেট পড়তে আসা ছেলে মেয়েরা পতংগের মত অপেক্ষা করতে থাকে। রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এই পড়ানো চলতেই থাকত। ফলে আমার খাওয়া, গোসল আর পড়াশোনা বলতে যা কিছু আছে তার সবই নির্ভর করত ফুপির উপর। তিনি তা নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। এদিকে আংকেলটা আসার সময় নাবিস্কো চকলেট নিয়ে আসতেন। প্রতিদিন কমপক্ষে তিন থেকে চার টাকা দিতেন ম্যাগপাই আইস্ক্রিম খাওয়ার জন্য। আমার সকল আবদার, অভাব, অভিযোগ সবই ছিল তার কাছে। সেজন্যই হয়ত দশটা বাজলেই আমি গেইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন আসবে, কখন আসবে সেই লোকটা…….. আমার কাল্পনিক বাবা/মা……

আমার ফুপি আর সেই আংকেলের বদ্ধমুল ধারনা ছিল আমি তাদের নিজেদের পারস্পরিক কথা শুনিনা। শুনলেও কিছু বোঝার বয়স আমার হয়নি। তাদের সব ধারনাকে অমুলক করে দিয়ে আমি তাদের কথা সব শুনতাম এবং বুঝতাম। তবে কাউকে কিছু বুঝতে দিতাম না। একদিন কি নিয়ে যেন ফুপির সাথে তার খিটিমিটি লেগে গেল। খুবই তুচ্ছ এবং সামান্য কারনে ধরে যাওয়া আগুন কোন কারন ছাড়াই দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল দুজনের মধ্যে। যে আগুন দুনিয়া লন্ডভন্ড করে দেয় তাঁর সুত্রপাত হয় সামান্য তুচ্ছ কোন কারন থেকে। আমি আল্লা আল্লা করছি, ফুপি যেন সর‍্যি হয়ে মাফ চেয়ে নেয়। কারন আজকের পুরো দোষ ফুপির। ঘটনা ঘটল উলটা। আংকেল বলে বসলেন তিনি জীবনে আর এ বাসায় আসবেন না, ফুপিও বলে বসল- যদি লজ্জা থাকে তিনি যেন আর না আসেন।

অবস্থার হঠাৎ এ ভুমিকম্পে আমার ছোট্র দুনিয়া প্রবলভাবে নাড়া খেল। ঝগড়া যে এর আগে হয়নি তা নয়, কিন্তু আজকের ঝগড়া কই পর্যন্ত গড়ায় আমি ভেবে পেলাম না। আংকেল কোন দিকে না তাকিয়ে ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে গেলেন। ফুপি নিষ্ঠুরের মত এ ঘটনা উপভোগ করলেন। এ অবস্থায় আমার কি করনীয় তা বুঝতে বুঝতেই যে কয়েক মিনিট কাটল তা আজ পর্যন্ত আমার যাতনার একটা পিউর অংশ। আমি পিছু পিছু দৌড় দিলাম। গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে ডানে বামে তাকালাম। কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। পুরো রাস্তা ফাকা, রোদের তাপে পুড়ে যাচ্ছে শহর। আমি যেন মুহুর্তেই পিতামাতা শুন্য হয়ে গেলাম। তিনি যদি না-ই আর আসেন এখানে আমি কার কাছে থাকব? তিনি ত আমার হৃদয়ে আগেই পিতামাতা হয়ে বসে আছেন। ঘরের দিকে ফিরে মনে হল আমার বাসাটা যেন আজকের মত নরকে পরিনত হয়েছে। তাকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েই দিলাম ছুট। গ্রাম থেকে সবে মাত্র শহরে এসেছি। কোন কিছু চিনিনা বলে বাইরে বেরুনো আমার নিষেধ। আমি যেন সকল বাধ ভেংগে দৌড়াতে শুরু করলাম। কোনদিকে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি। শুধু জানি যে করেই হোক তাকে আমার খুজে বের করতে হবেই। প্রথমত তাকে ছাড়া আমি বাচতে পারব না, অন্যদিকে তাকে না পেলে আমি রাস্তা চিনে বাসায় ফিরতে পারব না। বাসা বলতে ছোট্র দুই রুমের একটা বেড়ার ঘর। আমাদের পুরো পরিবার গ্রামে থাকে। আমার যন্ত্রনায় অতিষ্ট হয়ে আম্মা আমাকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে। শহুরে নি:সংগতা আমাকে ঠেলে দিয়েছে স্বল্প পরিচিত একজন মানুষের উপর ……………

কতক্ষন রাস্তার পাশ ধরে অন্ধের মত দৌড়ে ছিলাম মনে নেই আজ। কিন্তু মনে আছে, আমি তাকে খুজে বের করে ফেললাম। তাকে জড়িয়ে ধরেই আমার সে কি বিকট চিৎকার। তিনি আমাকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন। আমার চোখ মুছে দিচ্ছেন হাত দিয়ে কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে অনবরত। আমি কাঁদতে কাদতেই বললাম -ফুপি, আপনাকে এখুনি ধরে নিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছেন আমার কাছে অন্তত তাই মনে হল। তিনি বড় দেখে একটা আইসক্রিম কিনে নিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন। আমি আল্লার কাছে ফরিয়াদ জানালাম ফুপি যেন কিছু না বলেন। আমার ভাবনা আর ফরিয়াদ সেদিন আল্লাহর আসন আরশ পর্যন্ত পৌছাতে পারল না। ফুপি তাকে দেখেই যেন আবার জ্বলে উঠলেন। তিনি তাঁর ভুলটা বুঝেই আইসক্রিমটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি আবার পিছু নিলাম। গেইট পর্যন্ত গিয়ে ধরা গলায় কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম, আগামীকাল তিনি আসছেন কিনা ? আমি জানি, এদিকে আসার দরকার তার ফুরিয়ে গিয়েছে………..

তারপরেও তিনি রোজ আসতেন। বাসার গেট থেকে বেশ দুরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমরা রোজ দেখা করতাম। দুজন দুজনকে ছাড়া আমাদের পক্ষে যেন বেচে থাকা অসম্ভব ছিল। সব কিছুরই শেষ আছে। এই নিয়মেই যেন কল্পনায় বানানো একজন পিতামাতাকে আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেললাম। দিনে দিনে আমি আরও বোবা আর বোকা হয়ে গেলাম………
আজ সারাটা দিন আমার কিভাবে কেটেছে এখন কিছুই মনে নেই। আমার সারাক্ষন মনে হচ্ছিল, একজন মানুষের জীবনে একই গল্প কি বারে বারে ফিরে আসে ? যদি আসে, সে কি দিনে দিনে আরও রুঢ আর নির্মম হয়ে ফিরে আসে ? যদি আসেই, আমার করনীয় কি ? আমি কেবল নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। যিনিই আমার কাছে আসেন তার সাথেই আমি দারুন কাউন্সেলিং করে সমস্যার মাল্টিপল সমাধান দিতে পারি কত সহজে। অথচ নিজের জীবনটাকে এখন কেমন যেন গোল্ডফিসের মত মনে হচ্ছে। মস্তিস্কে আমার স্মৃতি দু’সেকেন্ডের বেশিক্ষন থাকছে না। শুনেছি, মানুষ নাকি বিশেষ কোন সময়ে নিজের জীবনের পুরো চলচিত্রটা চোখের পলকে একবার হলেও দেখে। আজ সকাল থেকেই আমার মাথায় ঝড় বইছে। খন্ড খন্ড স্মৃতি এই আসছে, এই চলে যাচ্ছে। কোন স্মৃতিকেই ধরতে পারছি না। আমার খুব ইচ্ছে করছে জীবনের সকল স্মৃতি একে একে ফিরে আসুক। স্মৃতিময় অতীত দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে তাকে থামিয়ে দেব। আর বাড়তে দেব না। তা না হলে আরেকটি শিশু নিভৃতে অপেক্ষা করতে করতে আমার মত স্মৃতিহীন এবং বোবা প্রায় একটা প্রানীতে পরিনত হবে। আমি তা চাই না। এ ছায়াছবির রিমোটটা কেউ আমাকে এনে দাও। আমি একে থামাব। তা না হলে নতুন শিশুটির ভবিষ্যত শুন্যতা আমি দেখে ফেলব। এ আমি চাই না, এ যাতনা মরনের চেয়েও কষ্টের…. হিমালয়ের চেয়েও ভারী, সাত আসমানের দুরত্ব সমান পথ একাই হেটে যাবার মত অভাবনীয় কষ্টের !!

কেউ কি আমাকে একটা রিমোট দিতে পারেন ? জীবন চক্রের রিমোট কোথায় পাওয়া যায় জানেন কেউ। দুটো চোখের বিনিময় দিতে হলেও রিমোটটা আমি চাই। শিশুটিকে দেখার ক্ষমতা হারালেও তাকে ঠিক আমি অনুভব করতে পারব। তার গায়ের গন্ধ শুকবো। আমার এ আনন্দের কাছে চোখ দুটো হারানোর বেদনা এতটা তুচ্ছে যে আমি কোনদিন একে তুলনা করতে যাব না। কেউ কি একটা রিমোটের সন্ধান দিতে পারেন, প্লিজ……..

আমার জীবনের গল্পের কোনও অভিশপ্ত কিংবা আংশিক গল্প আমার সন্তান নিরুর জীবনে ফিরে আসুক, মা হয়ে আমি তা কিভাবে কল্পনা করি বলো ? আমার নামে অনেক মন্দ রটিয়ে দিও। সাবধান নিজ মুখে ছেলের সামনে কিছু বলবে না। তোমার কোন রেফারেন্সও রাখবে না। বড় হয়ে সে যদি এসব চালাকি বুঝে যায় তাহলে সে আরও একা হয়ে যাবে। আমার ছেলেটা যেন কখনো একা না হয়। সে আজ থেকে শুধুমাত্র মাতৃস্নেহ বঞ্চিৎ হলো। এ তাঁর নিয়তি। দোষ সব আমার। তুমি তারে বছরে একবার গঙ্গা জলে স্নান দিও। কেন বললাম তা জিজ্ঞেস করো না। এটা আমার একটা বিশেষ আবদার।

সত্য বলার শিক্ষা তাকে দিও না, বাধাও দিও না। ধর্মের জন্য চাপাচাপি করো না। ধর্ম বিদ্বেষী হতেও দিও না। সত্যকে সে নিজে খুঁজে নিতে পারবে। আমরা শৈশবে অনেক মার প্যাচের সত্য শিখেছি। এসব মার প্যাচের সত্যের চেয়ে মিথ্যা বলতে না পারার গুন অনেক বড়।

১৭/০৪/২৩ ইং,
কুমিল্লা।

প্রিয় কথকতা