`‌ফ্যাসিবাদের পুলিশকে উপেক্ষা ছয়লাপ হওয়া জনসভায় মানুষের আশা মিটলো না’

আপডেট: জুলাই ১৪, ২০২৩
0

মাহমুদুর রহমান

বাংলাদেশের জনগণের, বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের ফ্যাসিবাদের সকল প্রকার জুলুম এবং সীমাহীন দুর্নীতি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়ার কাপুরুষতা দেখে এই বুড়ো বয়সে কষ্ট করে লেখালেখির উৎসাহ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। পাঁচ বছর জেল খাটা, একাধিকবার শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়া, প্রাণঘাতি হামলা থেকে মহান আল্লাহ’র রহমতে বেঁচে ফেরা এবং নির্বাসিত জীবনের নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে আরো প্রায় পাঁচ বছর লেখালেখি করার পর মনে হচ্ছে, আমার এবার অবসর নেয়ার পালা। নতুন লেখক, নতুন নেতাদের আগমন ঘটেছে। সত্তর বছরে পৌঁছে আমাদের তো জায়গা ছেড়ে দেয়াই উচিৎ। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া আর লিখব না এমনটাই মনস্থ: করেছিলাম। সর্বশেষ সম্পাদকীয় কবে লিখেছিলাম তাও ভুলে গেছি। অলিউল্লাহ নোমান দফায় দফায় তাড়া দিলেও, কোনরকম গা করছিলাম না। শেষ পর্যন্ত, বিএনপির দফার বাহারে চমৎকৃত হয়েই বেশ লম্বা বিরতি দিয়ে আজ আবার ল্যাপটপের সামনে বসলাম।

প্রথমেই এক দফার কথা বলি। জুলাইয়ের ১২ তারিখের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের আগ্রহের কমতি ছিল না। এমনকি বিদেশীদেরও দৃষ্টি ছিল। গত বছর ১০ ডিসেম্বর হাসিনার ব্যক্তিগত ‘ডেথ স্কোয়াড’ এর সদস্যরা (হারুন, বিপ্লব, মেহেদি, গং) লাঠি চার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ছুড়ে, গুলি করে এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে নয়া পল্টনে নির্ধারিত জনসভা হতে দেয় নাই। এবার মার্কিন স্যাংকশনের ভয়ে সেই ডেথ স্কোয়াড মাঠে ছিল না। ফলে বিএনপির জনসভাও হয়েছে দেখার মত। বিদেশ থেকে মিডিয়াতে দেখে আমার ধারনা, বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া এত বড় জনসভা দলটি এর আগে কোথাও, কখনও আয়োজন করতে পারেনি। জনসভার ব্যাপকতা দেখে বোঝাই গেছে যে, এবার রাজধানীর বাসিন্দারাও স্বত:স্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নিয়েছিল। বিরূপ আবহাওয়া এবং ফ্যাসিবাদের পুলিশকে রীতিমত উপেক্ষা করে মানুষ জনসভাকে ছয়লাপ করে দিয়েছে।

চিরাচরিতভাবেই বিএনপির মঞ্চে সেদিন বক্তার অভাব ছিল না। অথচ দেশের মানুষের আশা মিটলো না। কেবল গৎবাঁধাই নয়, একেবারে নির্জীব সব ভাষণ। এমন ঐতিহাসিক জনসভায় যে ধরনের উদ্দীপনাময় বক্তব্য আশা করা হয়, সেই প্রত্যাশা মিটলো কই? মহাসচিবের কন্ঠে বহুল প্রত্যাশিত এক দফার ঘোষণা এলো বটে। কিন্তু, সেই এক দফার সাথে এতগুলো সাব-দফা জড়িয়ে দেয়া হলো যে, ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফার প্রত্যয় অনেকটাই যেন হালকা হয়ে গেল। তারপর যে মৃদু কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো তাতে আমি নিশ্চিত যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা অন্তত: বেজায় খুশি হয়েছেন। এই ধরনের পদযাত্রা বিএনপি তো বোধহয় ইতিমধ্যে কয়েক ডজন বার করে ফেলেছে। কর্মসূচিতে নতুনত্ব কই? অন্ততপক্ষে, হাসিনার বশংবদ নির্বাচন কমিশন ভেংগে দেওয়ার দাবিতে সেই অফিস ঘেরাও কর্মসূচিটাও আসতে পারতো। যাই হোক, এগুলো দলটির নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার। প্রসঙ্গক্রমে, পাঠকদের শুধু ২০১৮ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছি।

বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ ভুয়া মামলার জেলে নিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির নেতারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে মূলত: জাতীয় প্রেস ক্লাবের অন্দরে-বাহিরে তাদের ঠিকানা বানিয়ে নিলেন। এদিকে তলে তলে ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলতে থাকলো। আমি তখনও বাংলাদেশে। বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের অনুষ্ঠানে যাই, বক্তৃতা দেই। সেদিন আমরা যারা আন্দোলনের নখদন্তহীন কর্মসূচি এবং হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলাম তাদের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ এনে প্রকারান্তরে হাসিনার এজেন্টের তকমা লাগিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলেছিল। নেতারা আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে একজোট হয়ে বলতে লাগলেন, কোনরকম হঠকারি কর্মসূচি দিয়ে “হাসিনার পাতা ফাঁদে” পা দেয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের মধ্যরাতের নির্বাচনে অংশ নিয়ে কারা হাসিনার পাতা ফাঁদে সেদিন পা দিয়েছিল তার বিচার ইতিহাস করেছে। নেড়া নাকি এক বারই বেল তলায় যায়। ১২ এবং ১৩ জুলাইয়ের বিএনপির কাজকারবারে ভয় হচ্ছে, এবারও বোকা নেড়া বেলতলায় যায় কিনা?

১২ জুলাই এক দফা ঘোষণার পর চব্বিশ ঘন্টা পার না হতেই বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতারা দলীয় চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৩১ দফা ঘোষণা করলেন। ১ দফা ঘোষণার পরেরদিনের এই ৩১ দফা প্রচারের বিশেষ উদ্দেশ্য বিএনপির নীতিনির্ধারকরাই ভাল বলতে পারবেন। আমরা, আমজনতার দল কিন্তু, একেবারে বিমূঢ় হয়ে গেছি। এই একত্রিশ দফার উদ্দীষ্ট দর্শক/শ্রোতা কি বাংলাদেশের জনগণ নাকি আমেরিকা নাকি ভারত সেটাও আমাদের অজানা। তবে একত্রিশ দফার মধ্যে মুসলমান কিংবা ইসলামের যে কোন স্থান নেই সেটা বেশ চোখে পড়েছে। এর আগেও বিএনপি ১০ দফা এবং ২৭ দফা ঘোষণা করেছিল। আমি সেই সময় থেকে গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন উৎখাতের এক দফার কথা বলে এসেছি। কনক সারওয়ারের সাথে টক শোতে বলেছি এবং আমার দেশ অনলাইনে একাধিক সম্পাদকীয়তে লিখেছি। অবশেষে বিএনপির এক দফা ঘোষণার সিদ্ধান্তে খুশিও হয়েছিলাম। কিন্তু, নতুন করে একত্রিশ দফা ঘোষণায় আমার আশংকা হচ্ছে, ঘটনা কি আবার যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই ফিরে গেল নাকি? প্রকারান্তরে, সবই কি নির্বাচনে অংশগ্রহণের দর কষাকষির অংশ? যখন গণতন্ত্রকামী সকল বিরোধী দলের সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের দিকে সকল মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করার কথা সেই সময় সর্ব বৃহৎ দলের ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনার রূপরেখার এই আকস্মিক প্রচার জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তারা কি বুঝে-শুঝেই ৩১ দফা দিয়ে ১ দফাকে হালকা করে দিলেন?

আমার লেখালেখির এক বিষম সমস্যা আছে। আমি সবাইকেই অসন্তুষ্ট করে ফেলি। লেখালেখির কারণে ভারত আমার চরম শত্রু। আমাকে ইসলামপন্থী বিবেচনা করার কারণে মার্কিনিরাও আমার মিত্র নয়। শেখ পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখির কারণে শেখ হাসিনার সাথে সম্পর্ক রীতিমত ব্যক্তিগত শত্রুতায় পৌঁছে গেছে। আমি রিমান্ডে গেলে আমার উপর যথেষ্ট নির্যাতন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে শেখ হাসিনা নিজে খবর নিতেন। আমার মা এবং স্ত্রীকেও শেখ হাসিনার সরকার ছাড় দেয় নাই। কিছুদিন আগে নব্য মিরজাফরদের বিষয়ে সাবধান করে সম্পাদকীয় লেখার ফলে চরমোনাই জাতীয় দলগুলো এবং সাত্তার উকিল মার্কা সুবিধাবাদিরা আমার উপর মহা খাপ্পা। জামাতের ৭১, ৮৬ এবং ৯৬ সালের ভূমিকার সমালোচনা করার কারণে তারাও বিরক্ত। ২০১৮ সালে আমি জামাতের নেতৃত্বকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। তখনও দলটির নেতারা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

বিএনপির মধ্যকার এক-এগারো এবং ভারতপন্থী গোষ্ঠীর কাছে আমি এক বিশাল উপদ্রব। সরাসরি আমি দলে নাই বিধায় তারা অনেকটাই অসহায়। দল থেকে আমাকে বহিষ্কারের তো কোন সুযোগ নাই। বিএনপির বর্তমান শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা আজকের সম্পাদকীয় পড়ার সময় পেলে নিশ্চয়ই সমস্বরে আমার মুন্ডুপাতে লেগে যাবেন। তবে সুবিধার কথা হলো, বিএনপির নেতারা আমার লেখা পড়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন না। তারা এমনতিতেই পড়েন কম। কখনও পড়ার ইচ্ছা হলে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল, প্রথম আলো তাদের কাছে সব চেয়ে পছন্দের পত্রিকা। পত্রিকাটি জন্মলাভের পর থেকে জিয়া পরিবারের উপর অবিরত কলসির কানা মেরে গেলেও বিএনপির নেতাদের একতরফা প্রেমের কোন কমতি নেই। রাজনীতিবেদদের আজ আর অতিরিক্ত কিছু বলতে চাই না।

বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে আমার শেষ কথা, এবারের মুক্তির সুযোগ হেলায় হারালে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের ও হাসিনার ফ্যাসিবাদের অধীনে দাসত্ব চিরস্থায়ি হয়ে যেতে পারে। যে জাতি নিজেরা মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে না তাদের আল্লাহ’র রহমতের প্রত্যাশা করাও অনুচিত। বিদেশীরা নিজের স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া কেবল আপনাদের মুক্তি দিতে কোন দিনই আসবে না। ২০০৮ সালে আমি লিখেছিলাম, এবারের বাকশাল দীর্ঘস্থায়ী হবে। ২০২৩ সালে বলে যাচ্ছি, সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফার সংগ্রামে কোনরকম দোদুল্যমানতা দেখালে হাসিনার শাসনই আপনাদের ভবিতব্য। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
১৪/০৭/২০২৩

সূত্র : লেখাটি আজ লন্ডন থেকে আমার দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছে