বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬৭০ কোটি টাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

আপডেট: জুলাই ২০, ২০২১
0

করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদেশি বিনিয়োগে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) প্রবাহ কমেছে ৩১ কোটি ৪ লাখ ডলার।স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এফডিআই এসেছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২৪ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা কমে এসেছে ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ঋণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি রোববার প্রকাশ করা হয়।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে পুঁজি দেশে আনতে পারে।

এগুলো হচ্ছে-১. মূলধন হিসাবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসাবে ২. দেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে দেশে বিনিয়োগ করে এবং ৩. এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। এ তিন পদ্ধতির যে কোনোভাবে বিনিয়োগ করলে তা এফডিআই হিসাবে গণ্য করা হয়।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। এর মধ্যে গত বছর কমেছে মূলত করোনার কারণে। করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশেও পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে।

তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশে বিনিয়োগ পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়ছে না কেন। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে বিদেশ থেকে মূল পুঁজি আনা ও কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ ব্যাপকভাবে কমেছে। এ কারণে সার্বিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে।

২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মূল পুঁজি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ কমেছে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ। মূলত মূল পুঁজি ও অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ বেশি হারে না বাড়ায় এবং এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে। ২০১৯ সালে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ২৯ লাখ ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৫২ লাখ ডলারে। আলোচ্য সময়ে এফডিআই কমেছে ৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

আলোচ্য সময়ে মোট বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

গত বছর দেশে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।

২০১৭ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ২১৫ কোটি ১৬ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে তা আবার কমে ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারে নেমে যায়। ২০২০ সালে তা আরও কমে ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে নামে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশি বিনিয়োগও কম হচ্ছে। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগও কম। এছাড়া করোনার কারণে গত বছর ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারেই স্থবির ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, করোনার প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। ফলে এ বছর বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। দেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুত শেষ হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক তৃতীয়াংশ।

আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিশরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলোর ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।