মেঘ-বর্ষাকে কবি সাহিত্যিকরা ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে

আপডেট: জুন ১৮, ২০২৩
0

বৃষ্টিস্নাত সজীবতার রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে আষাঢ়ের বর্ষা। এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে,
এসো করো স্নান নবধারা জলে॥ চিরচেনা রূপেই আষাঢ়ের গত ৪ দিন ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টি অবিরাম চলছে। অঝোর ধারার বর্ষা নামে। মন উদাস করা রিমঝিম ছন্দ । সবুজ পাতায় সারাদনই জমে থাকে টলটলে বৃষ্টিজল। মৌসুমী বা্য়ুর প্রভাবে নদীতে বান ডাকছে। প্রকৃতির সেই চিরায়ত নিয়ম মেনে আবারও এসেছে বর্ষা।

বর্ষা কতটা মধুর-বেদনার আর কতটাই বা রোমান্টিক! বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালীর কত যে ঋতু বন্দনা। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতিতে মানবমানবীর হৃদয়ের আবেগের ধারা তৈরি করেছেন, যেখানে চোখের জলও ভাললাগার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলা কাব্যে সাহিত্যে সঙ্গীতে বর্ষাকে নিয়ে যত গান যত কবিতা যত গল্প যত উপন্যাস অন্য কোন ঋতু নিয়ে এতটা নেই। বর্ষার এই ধারা গীতিকারদের সুর তুলে দিয়েছে। সতীনাথের কণ্ঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিম ঝিমরিম ঝিমঝিম গান গেয়ে যাই’… মান্না দে’র কণ্ঠে ‘ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে’…. হেমন্তের কণ্ঠে ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’… লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো তো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষা হাওয়া হিম হিম হিম পরসা’ সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষারও প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়’…।


বর্ষার বাদল দিনে এসব গান হৃদয় বীণায় আকুতি জাগায় সুর তোলে। বর্ষার কাব্যধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ীদাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতা মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ মেঘকে ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে। বর্ষায় আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্ণের মেঘ।

মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেক পারেই রঙধনু। কালিদাসের বর্ণনায় রেবা নদীর তীরে বর্ষার দিনে মালবিকা প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় ছিল। এর মধ্যেই হলুদ বরণ গায়ক দল হেঁড়ে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তুলে বর্ষার বারতাই জানিয়ে দেয়। বর্ষার সত্তা ঘিরে আছে মানুষের জেগে ওঠার, সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান।

নদ নদী ফুলে ফেঁপে রুদ্ররূপ ধারণ করলে নদী তীর ও চরগ্রামের মানুষ জেগে ওঠে অস্তিত্ব রক্ষায়। মাটির বাঁধও যখন রক্ষা করতে পারে না তখন মানব জীবনের সঙ্গে পশুপাখির জীবন রক্ষার তাগিদও মানবিক গুণাবলীতে যোগ হয়। তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার বৈঠা ঠেলে ভাঙ্গন কবলিত মানুষ পাড়ি দেয় শুকনো ভূমির আশ্রয়ে। ভালবাসার বন্ধনে নদীভাঙ্গা মানুষ একাকার হয়ে যায়। বর্ষার কালো মেঘের মধ্যেই দেখা মেলে এক অরুণ আলোর। বর্ষায় অনুষঙ্গ যাই থাক বৃষ্টির সুর মানব-মানবীর হৃদয়কে মধুছন্দে নাচিয়ে তোলে। গ্রামে টিনের চালাঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ধ্রুপদী সুর তোলে।

হাওর অঞ্চলে মেঘমল্লার

তরুণরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢলের জলে। আগের দিন যেখানে ছিল শুকনো সড়ক রাতভর বৃষ্টিতে সেই সড়ক ডুবে গেলেই ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। ‘বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল করেছ দান…’ কবিগুরু কদমকে এভাবে ব্যঞ্জনা দিয়েছেন গানের সুরে। গ্রামীণ জীবনের এই ধারার পাশে নগর জীবন আরেক ধারার। যেখানে বৃষ্টি দুর্ভোগ।
বর্ষার এমন জীবনেই মানুষের পথ চলা- ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে…’।