রানী কাহিনী

আপডেট: মার্চ ৩, ২০২৩
0

মাহমুদা ডলি

অনেক বছর পর অফিসের কাজের জন্য ফিরে এলাম বিজয়নগরে। পরিবর্তন হয়েছে গ্রামের অনেক কিছুর। চেনা মুখগুলো অনেকটা অচেনা হয়ে গেছে। শুধু প্রকৃতি তার নিয়মেই পালাবদল করে চলছে প্রতিনিয়ত। এই গ্রামকে ভালোবাসতাম খুব। গ্রামের মানুষগুলোর প্রতি রয়েছে শুধু ঘৃনা আর ক্ষোভ। আমি বিকেল বেলা গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীর তীরে হাঁটতে লাগলাম। মনে পড়ে গেল সেসব দিনের কথা। সেই শান বাঁধানো ঘাট, গৃহবধু রানীর কথা। সেদিনও ছিল এমন একটা দিন।

গোধূলি লগ্নে নদীর ঘাটে বসে আছি আমি। দখিনা বাতাস এসে গাছগুলোকে দোলা দিয়ে যায় । ভরা জোয়ারে মৃদু ঢেউ ঘাটের শুকনো সিঁড়ি ভিজিয়ে দিয়ে যায়। দহৃরে অদহৃরে দেখা যায়,লাল-নীল শিমুল পলাশ জারুলের বীথিকা মঞ্জুরি। দূরের আকাশ থেকে আমার মনটা ফিরে এলো কারো কন্ঠস্বরে।
কি করছ এশা? পেছন পানে তাকালাম। কি অপরহৃপা রমণী মহৃর্তি। কপালে সিঁদহৃর, দুধে আলতা গায়ের বরণ, নাক যেন বাশিঁর মতো। পরণে মলিন ছেড়াঁ কাপড়। সে আমার নিরবতা ভেগ্ধেগ দিয়ে বলল, তুমি নীলা আপার বোন , তাই না ? মাথা নাড়লাম। বুঝলাম আজই ওই পাড়ায় যে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে সেই বিজয় মিত্রের বউ রানী। দুপুর বেলা আপা যখন একটা পাত্রে কিছু চাল, ডাল, আর দুটো আলু নিয়ে ওদিকটায় যাচ্ছিলেন, আমি জানতে চেয়ে ছিলাম কি হবে ওগুলো দিয়ে। বলেছিলেন, বিজয় দাদার নতুন বাসায় এক মুঠো চাল নেই যে, তার শিশু সল্পøানের মুখে তুলে দেবে।
আপার মুখে এর আগেও শুনেছি বিজয় বাবুদের কথা। তার স্টúী রানীর কথা। আজ দেখলাম সেই নারীকে,সেই রানীকে। রানীকে পাশে ডেকে বসালাম। সে আমার মুখোমুখি সিড়িঁর অপর প্রান্তে বসতেই আরো ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।

আমার বোন নীলা আপা এনজিওর বড় কর্মকর্তা । সেই সুবাদে এই এলাকায় সবার সাথেই তার ভালো সর্ম্পক। যদিও এলাকাটি একটি সন্ত্রাসী জনপদ। লোকে বলে আপার সাহসিকতা , প্রবল ব্যক্তিÍে^র জন্য এবং তার সততায় এ এলাকার বাঘে-মহিষে নাকি এক ঘাটে জল খায়। আমার ভাবনাগুলোর মাঝে ছেদ পড়লো রানীর কথায়। বলল-এশা সল্পব্দ্যা হয়ে গেছে যাই। আমি তাকে বাসায় নিয়ে গেলাম। চা খেতে খেতে বলল, জান আজ নাকি স্ট‹ুলের পাশে ধানক্ষেতে একটা কিশোরী মেয়ে পড়ে আছে? আমি আঁতকে উঠলাম। তার মুখের দিকে কিছু জিজ্ঞাসার দৃস্টিতে তাকালাম। সে বলল, কিশোরীর বুক, নাভি আর মুখটা একদম ছিড়ে ফেলেছে বদমাশরা। কেউ কেউ বলেছে, মেয়েটাকে নির্যাতন শেষে ফেলে রেখেছে। আমার বুকটা কেপেঁ উঠলো ! কি অন্যায় চলছে গ্রামে! আমি প্রসগ্ধগটা ঘুরিয়ে বললাম , এটা থাক। তুমি তোমার কথা বল বৌদি । শুনলাম তোমার শ^শুরকুলের লোকেরা খুব অত্যাচার করে?

এতক্ষণ পর হাসি ভাবটা উবে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পাশের গ্রামের খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে সে। পিতা হারা তিন ভাই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয় পরিবারের অভাব অনটনের মধ্যে রানীরা বড় হয়েছে। কুড়ি বছর বয়সেও বিয়ে দিতে পারেনি। অন্যদিকে বড় ভাইয়ের বউও এতটুকু সইতে পারেনা দু‘বোনকে।

সংসারে চোখের বালি হয়ে পড়ে রয়েছে তারা। তিন বেলার মধ্যে দু‘বেলা হয়তো না খেয়ে থাকতে হতো কখনো। একদিন উগ্রবাদী সন্ত্রাসী দলের নেতা বিজয় অন্য দলের ধাওয়ার মুখে পড়ে রানীদের বাড়ি আশ্রয় নেয়। সে সময় সে রানীকে পছন্দ করে। পরে রানীকে নিয়ে আসে বিজয়দের বাড়িতে। বিয়ে করে হিন্দু ধর্মমতে। রানী ধর্মান্তরিত হয়। রানী বিজয়ের কাছে ধর্মের ব্যাপারে আপত্তি করেনি এক মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য; আর একটু ভালো থাকা, সুখে থাকার জন্য। কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই পড়লো বিজয়ের বাবা-মায়ের। কতই না আশা ছিল। , ছেলের বিয়েতে অনেক যৌতুক পাবে; রানীকে বিয়ে করার পর কানাকড়ি তো পায়নি বরং তার জাত গেল যে! বিয়ের পরই অত্যাচার। বিজয়ের অজাল্পেø রানীকে খোঁড়া অজুহাতে মারধর করত। কখনো সামনে থেকে খাবারের থালা উল্টে দিত। দেওরজি কখনো সাইকেলের চেন বা প্যান্টের বেল্কল্ট দিয়ে পেটাতো। শ্বাশড়ী ননদ মিলে রান্নার খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দিত। কয়েকদিন আগে গীতা পাঠ করতে দিয়েছিল বিজয়ের বাবা। রানী পড়তে না পারায় হাত মাটির ওপর চেপে ধরে ইট দিয়ে থেতলে দেয়। বিজয় শুধু নিরব ভুমিকা পালন করে।

তার বাবা মায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু দশ বারো দিন আগে বিজয়কে প্রতিপক্ষরা ধরে নিয়ে যায় । এ সময় রানী তার বাবার বাড়ি ছিল। খবর পেয়ে ছুটে যায় মহিষাচরে। যেখানে বিজয়কে প্রতিপক্ষরা মেরে ফেলার জন্য নিয়ে গেছে। রানীর আকুতি মিনতি আর অসহায়তা দেখে ছেড়ে দেয়। তবে শর্ত দিয়ে দেয় ওই দল তাকে ছেড়ে দিতে হবে। রানী কথা দেয় বিজয় কোনদিন আর অস্ত্র হাতে নেবে না। পরে নীলা আপা বিজয়কে পত্রিকার ব্যবসা ধরিয়ে দেয়। আর বিজয় রানীকে নিয়ে আসে বন্দরে। একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নেয়। রানী বলল,সংসারে টানাপোড়েন কমানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কিই বা করতে পারে সে। কিছুদিন পরে বিজয়ের বাসার সামনে একজন ব্যংকারের বাসায় কাজ পেল রানী। ব্যাংকার সরোয়ার সাহেবের চাকরির মেয়াদ আর দেড় বছর। তার পরিবার-পরিজন থাকে শহরে। সে মেস বাড়িতে খাকে। ভালোই ছিল রানী মাসখানেক। খাবার বেতনটা ঠিক মতোই পেয়েছিল। একদিন সকালে রানী এলো আমাদের বাসায়। নীলা আপাকে খুঁজতে লাগলো।

আমি জানতে চাইলাম কেন? রানী বলর, সরোয়ার রানীকে মা বলে সম্বোধন করতো। ওই দিন সকাল বেলা বলল,রানী তোর সঙ্গে যদি আরো দশ বছর আগে দেখা হতো! রানী বলল, কেন কাকা? সে রানীর কাপড়ের আচলঁ টেনে কাছে টানতে টানতে বলল , আমি তোকে বিয়ে করতাম। শুনে রানী এক ঝটকায় আচলঁ টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে মেস থেকে ছুটে আসে। বললো, জান না, সে প্রায়ই আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো; আমি বুঝতে পারিনি। রানী কাঁদতে লাগলো। নিদারুন কষ্টটা বুকে চেপে রাখতে পারেনি। তার বুকের ভেতরটা যে হাহাকার করছে তা যেন আমি শুনতে পাচ্ছি।
তবুও থেমে নেই সে। যখন তার ঘুমন্ত শিশুর শুকনো মুখের পানে তাকায় তখন আর সে স্থীর থাকতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় এখানে -ওখানে। একটু কাজ খোজার জন্য ছুটে বেরাতো বন্দরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু বন্দরের বৃদ্ধ তরুন জওয়ানরা সবারই নজর ছিল রাণীর যৌবনের ওপর। অথচ রানী যে একমুঠো অন্নের জন্য কাজ খুঁজে বেরাতো এ নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা ছিল না।

সেদিন সল্পব্দ্যায় রানী আবার ছুটে এলো নীলা আপার খোঁজে। বললাম , অফিসের কাজে শহরে গেছে রাতে ফিরবেন। রানী বলল, গতকাল রাতে অমল ডাক্তারের ওষুধের দোকানে চুরি হয়েছে ; আর পুলিশ কিছুক্ষণ আগে বিজয়কে ধরে নিয়ে গেছে চুরির অপরাদে। রানী স্ট’াণয়ি বাবুল মেল্ফ^ারকে অনুরোধ করেছিল বিজয়কে ছাড়িয়ে আনার জন্য। বাবুল মেল্ফ^ার বলল, বিজয় একদিন জেলে না থাকলে যে রানীকে সে একরাত্রের জন্য পাবে না। রানীর কথা শুনতে শুনতে আমি ঠায় দাঁিড়য়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর নীলা আপা ফিরে এসে পাচঁশ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন বিজয়কে।

পরদির রাতে গেলাম রানী বৌদির বাসায় । দেখলাম রানীর চুলগুলো এলোমেলো, মুখ ফুলে গেছে। দীর্ঘশ^াস নিচ্ছে আর চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরছে। জানতে চাইলাম, বিজয়ের সাথে কি হয়েছে? সে বলল, সবাই নালিশ করেছে, রানী নাকি বাজে মেয়ে মানুষ হয়ে গেছে, সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরায় , হাসাহাসি করে,আনাচে কানাচে দেখা যায়। এতো নোংরা ছি ! ছি! করছে নাকি বিজয়কে দেখলেই।
আমার মুখে কোন ভাষা এলো না। যে নারী তার স্বামী -সন্তানের মুখে এক মুঠো ভাত দেয়ার জন্য এতো অপবাদ, এতো খারাপ নজরকেও এড়িয়ে, তোয়াক্কা না করে একটা কাজের জন্য সবার দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিচ্ছে। তখন তার দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে এ সমাজের মুখোশধারীরা কামনা চরিতার্থ করতে না পেরে তার নামে বদনাম রটায়। আর সেই নারীর পতি যদি তা বিশ্বাস করে তাহলে তার আর কিই বা করার থাকে। এসব লোকের বিরুদ্ধে তো আর রুখে দাড়াতে পারবে না রানী।

সকাল বেলা। নদীর ওপারের হিন্দু বধহৃরা পহৃজো শেষে ফুলগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে স্টুান করছে। আমি শুধু সাত পাচঁ ভাবছি ওদের দেখে। এমন সময় বিজয় বাবু এলেন। বললেন, এশা তোমার বৌদিকে দেখেছ? আমি চমকে উঠলাম কেন? বৌদি কোথায়?
বিজয় বাবু কাঁদতে কাদঁতে বললেন, নদীর ঘাটে তার শাঁখা আর কাপড় পেলাম; কিন্তু তাকে কোথাও খুজে পেলাম না। এত বড় পৃথিবীতে তাকে আমি কোথায় খুজবো?
আমি বুঝলাম, নারীরা বাইরের লোকের দেয়া শত কটুক্তি , শত অপবাদ সইতে পারে। কিন্তু তার মনপ্রাণ, তার দেহ যাকে দান করে ,সেই স্বামীর তার দেয়া বদনাম সে সইতে পারে না।
এইতো কাল সন্ধায় রানী কতগুলো ফুল নিয়ে এসেছিল নদীর ঘাটে। আমি জানতে চাইলাম, এতো বিভিন্ন ধরনের ফুল। রানী ফুলগুলো জলে ভাসিয়ে দিতে বলল, আমি এখন জানি কোন ফুল দিয়ে কোন দেবতাকে পহৃজো করতে হয়। আমি হেসে ওঠায়; সে বলল- হ্যা বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন ফুলে সন্তুষ্ট হয়। আমিও চাই দেবতারা আমাকে গ্রহন করুক।’