রেজাউদ্দিন স্টালিনের মুখোমুখি: ‘কবিতা হচ্ছে সময় ক্ষোভ ও স্বপ্নের সমার্থক’

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১
0

কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর যশোর জেলার নলভাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাসাহিত্যের একজন ভিন্নধারার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত কবি তিনি। মানুষকে আবিষ্কার করেন তাঁর ঐতিহ্যের চোখ দিয়ে আর কাব্যকলার নির্যাসকে উন্মোচন করেন ইতিহাসের ইতিবাচক বাকপ্রতিমায়। তাঁর কবিতায় বারংবার প্রতিভাসিত হয় গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন, জীবনদর্শন-প্রকৃতি-রাজনীতি-সমাজ-পুরাণ-গা-গঞ্জ-ন্যায়-অন্যায়-প্রেম-বিরহ-আনন্দ । জীবন ও জগতের সবকিছু ছুয়ে-ছেনে দেখেছেন বলেই একজন ভিন্নস্বরের কবি হিসেবে তার আত্মপরিচিতি। কবির নিরবচ্ছিন্ন লেখনী আমাদের জাতিসত্তার জাগরণে সদাজাগরুক। কবিতাই জীবনের অণি¦ষ্ট মিরো¤œাভ হলুভের ভাষায় কবিতা আমাদের শেষ কাজগুলোর নয় বরং প্রথম কাজগুলোর অন্যতম, রেজাউদ্দিন স্টালিন গভীরভাবে তা’ বিশ্বাস করেন। ধারাবাহিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী,মাইকেল মধুসূদন,সিটি আনন্দ আলো,ধারা সাহিত্য সাংস্কৃতিক আসর,পদক্ষেপ,অগ্নিবীণা,ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, পা-ুলিপি, দার্জিলিং নাট্যচক্র, সব্যসাচী, তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া ও আমেরিকার বাদাম পুরষ্কারসহ নানা সম্মাননা ও পুরষ্কার। তাঁর প্রতিবাদী কাব্যভাষা-পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে অব্যর্থ অস্ত্র যা তাকে দিয়েছে অর্জুনসম তীরন্দাজের অভিধা। অক্টাভিও পাজের ভাষায় কবি হবেন একই সাথে-তীর, তীরন্দাজ এবং চাঁদমারী রেজাউদ্দিন স্টালিন এই উক্তির সমার্থক; জনতার লোক হিসেবেই সর্বজনগ্রাহ্য তিনি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে দেশের সীমা অতিক্রম করে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪০, গদ্যগ্রন্থ ৪টি, শিশুতোষগ্রন্থ ২টি, উপন্যাস ১টি, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ২টি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-ফিরিনি অবাধ্য আমি, আশ্চর্য আয়নাগুলো, আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে, ভাঙা দালানের স্বরলিপি, মুহূর্তের মহাকাব্য,জমজ সহোদর, সব জন্মে শক্র ছিলো যে, বায়োডাটা,জ্যামিতি বাক্রের গল্প। গদ্যগ্রন্থ-আরোগ্য রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের আত্মনৈরাত্ম, নির্বাসিত তারুণ্য, ডাকঘর। উপন্যাস-সম্পর্কেরা ভাঙে। শিশুতোষ গ্রন্থ- হাঁটতে থাকো,চাবুক। এ খ্যাতিমান কবির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ লেখক ও গবেষক বঙ্গ রাখাল।

১.আপনার বেড়ে ওঠা, শৈশবের প্রতিবেশ আর স্মৃতি কিভাবে আপনাকে স্পর্শ করে?
উত্তর: আমি মনে করি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের শৈশব কৈশোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডব্লিউ বি ইয়েটস এরকমই ভাবতেন। শৈশবের শিশির ভেজা ঘাসজমি,সবজিক্ষেত, শীতের সূর্যের উত্তাপ, খেজুরের মধুরস,আমার বুড়িমার রান্না, বাবার পুনর্বিবাহ এবং পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাবস্থায় শতদল পত্রিকায় শপথ নামে ছড়া প্রকাশ-এসব মাঝে মাঝে বিদ্যুতর বেগে স্পৃষ্ট করে দিয়ে যায়। পঞ্চমশ্রেণীতে পাস দেয়ার পর পরই শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমরা যশোর নিউমার্কেটের বাড়িতে অবরুদ্ধাবস্থায় ছিলাম জুলাই’৭১ পর্যন্ত। দেখেছি পাঞ্জাবী,রাজাকারদের সীমাহীন দৌরাত্ম। আগষ্টের প্রথমেই অবাঙালীদের তাড়নায় ছাড়তে হলো যশোর- এলাম আমার জন্মভিটা গ্রাম নলভাঙা-নানী বাড়িতে। শরণার্থীদের স্রোত যাচ্ছিলো গ্রামের ওপর দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা আসছিলো ট্রেনিং শেষে। আমি মুক্তি যোদ্ধাদের পানি,কলা ইত্যাদি খাওয়াতাম আর কবে বিজয় হবে জানতে চাইতাম। মাঝে মাঝে আমার মুক্তিযোদ্ধা মামারা আমাকে শরণার্থীদের কিছুদূর এগিয়ে দিতে বলতো। যেতাম তাদের সাথে-কী অবর্ণনীয় ভোগান্তি তাদের বৃদ্ধা মা মরে যাচ্ছে, তাকে ফেলে দিতে হচ্ছে পথেই। যুবতী মেয়েরা স্থানীয় বখাটে মাতব্বরদের দ্বারা লাঞ্চিত হচ্ছে। টাকা পয়সা দিতে হচ্ছে দালালদের। গ্রামবাসীরা অতিথিদের সেবায় এগিয়ে আসতো। ঐ বয়সেই মুক্তির অসীম উন্মাদনা আমাকে জেকে ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কোন বাড়িতে দুপুরে কিংবা রাতে খাবে তা ঠিক করার দায়িত্ব পড়তো আমার ওপর। আমি মুসলিম লীগারদের বাড়িতে খাওয়া ঠিক করতাম। সারাদিন স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্যে রেডিওর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম-আর গাইতাম ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’।
২. আপনার কাছে কবিতার সংজ্ঞা কি?
উত্তর: কবিতার কোনো সর্বজনবিদিত সংজ্ঞা নেই বিষয়টি আপেক্ষিক-তবে অনেকেই দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অধুনা এক মার্কিন কবি অ্যালেক্র হ্যালি বলছেন কবিতা হলো- সময় ক্ষোভ ও স্বপ্নের সমার্থক। রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞা আছে তা’ এখন আমরা উদ্ধৃত করি না সংস্কৃত কবিরা বলেছেন অলংকার সমৃদ্ধ বাক্য বা উপমাই কবিতা। আমি মনে করি যতটুকু সাহস ততটুকু শিল্প ততটুকুই কবিতা।
৩.প্রথম কবিতা লেখার ঘটনা কি মনে আছে? কোথায় থাকতে কি লিখেছিলেন, তখন আপনার কবিতার বিষয়বস্তু কি ছিলো?
উত্তর: এসব কথা অনেকবার বলা হয়েছে। আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। আমার মা আয়েশা সরদার সম্পাদিত শতদল পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মসিউল আজম । মা বললেন অনেকে ছড়া কবিতা লিখছে- তুমি একটা ছড়া লিখে দাও। আমি চেষ্টা করে একটা লেখা দাঁড় করালাম। লেখাটির নাম দিলাম ‘শপথ’। ছাপা হলো। ছড়ার ৪ লাইন স্মৃতি থেকে তুলে দিচ্ছি-
পুষ্প যেমন মানব সেবায়
জীবন করে দান-
আমরা তেমন দেশের সেবায়
বিলিয়ে দেবো প্রাণ।
বিষয়ের বাধ্যবাধকতা ছিলো না তবে স্বাধীনতা সংগ্রাম অত্যাসন্ন মানুষের হৃদয়ে মুক্তির স্বপ্ন। আমার কবিতার বিষয় দেশ আর মানুষই ছিলো মুখ্য এখনো তা’ আছে।
৪. কবিতা কখন কবিতা হয়- আর কখন কবিতা নয়?
উত্তর: কবিতা কখনো সম্পূর্ণ হয় না-হয়ে ওঠে এবং সারাজীবন ধরে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি। কেউ কেউ যে কবি তা’ নির্ধারণ করে কে? তবে পাঠক যে কবিকে গ্রহণ করে নিশ্চয় সে কবি। পাঠক কবির সমকালে গ্রহণ না করলেও পরবর্তী প্রজন্ম ঐ কবির জন্যে বিলাপ করতে থাকে। বাংলাভাষায় তা জীবনানন্দের ক্ষেত্রে ঘটেছে আর ফরাসি সাহিত্যে র‌্যাবোর ক্ষেত্রে। আমি বলি সকলেই কবি-কেউ কেউ নয়। কবিতা কখন হয় আর কখন হয় না-তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব সময়ের কিংবা বলা যায় পাঠকের। এর অন্য একটা যৌক্তিক উত্তর দেয়া যাবে- এ হতে পারে হেরাক্লিটাসের নদীর পরিবর্তন। কোনো মানুষ এক নদীতে দু’বার স্নান করে না- কারণ জল সরে যায় , স্রোত আসে স্রোত যায়- সেরকম এক পাঠক এক বই বার বার পড়ে না দ্বিতীয় পাঠে সে বদলায়-অর্থ্যৎ আজকের মানুষ আগামীকালের মানুষ নয়-আগামীকালের মানুষ আজকের মানুষ হবে না।
৫.আপনি বিজ্ঞান,পুরাণ, মিথ, ইতিহাস,প্রকৃতি, রাজনীতিকে,অবলম্বন করে কবিতা লিখে চলেছেন আসলে আপনার কোন কবিতা টিকে থাকবে বলে মনে করেন?
উত্তর: কবিতা টিকে থাকা কঠিন। হাজার হাজার পৃষ্ঠা ও স্বরের মধ্য থেকে মানুষ বা পাঠক দু’একটা লাইন মনে রাখে- দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে-বাল্মিকীর সেই শ্লোক মা নিষাদ তমগম শ্বাশতী সমা যৎ কৌঞ্চ মিথুন দে-কামবোধি কাম মোহিতাম কিংবা ঈশ্বর গুপ্তের-আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। মধ্যযুগের আব্দুল হাকিম -যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানিÑ
আধুনিক কাল পর্যন্ত এলেও এরকম দু’একটি লাইন বলা যাবে। সেক্রপিয়ার,রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,জসীমউদ্দীন, সুকান্ত এদের উদ্ধৃতিযোগ্য মুখস্ত চরণ সাধারণ মানুষ অনেক বলতে পারে-যতদিন সাধারণ মানুষ দু’একটি লাইন উদ্ধৃতি না দেবে ততদিন- অমরত্বের বিষয় নিয়ে ভাবা বোকামি। আমার কয়েকটি কবিতা প্রায় চারদশকব্যাপী সচেতন পাঠকের মুখে আছে,- তিথোনাসের কান্না, সূচনাপর্ব, আয়না কি দরকার, বায়োডাটা ,তদন্তরিপোর্ট আরো দু’একটি কবিতা।
৬.বাঙালিদের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি? বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি কি টিকিয়ে রাখা সম্ভব না কি যুগের সাথে মেলাতে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতি হারাতে হবে?
উত্তর: আমি নিজে একজন খাটি বাঙালি। গ্রাম বাংলার নিসর্গ ও জনজীবন যত দরিদ্রই হোক তা আমার আরাধ্য। আমি জীবনানন্দ দাশের মতো বলতে চাই-বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর। কোন জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা দেশপ্রেমের ওপর নির্ভরশীল। যদি বাঙালি জাতির দেশপ্রেম প্রবল না হয়,যদি তারা বিস্মৃত হয় তার আত্মত্যাগকারী শহীদদের রক্তের কথা, লক্ষ যদি তারা না বোঝে তবে সমূহ বিপদ। নিজস্ব সংস্কৃতি ছাড়া কোনো জাতির মুক্তি নেই- এই অর্ন্তগত কথাটি বুঝতে হবে। টি এস এলিয়ট ঐতিহ্য রক্ষা নিয়ে বলেছেন-
একটা মহত্তম শ্রম দিয়ে তা’ আমাদের অর্জন করতে হবে-ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে । যুগের সাথে তাল মেলানো শব্দাবলি। বিজ্ঞানের-প্রযুক্তির নতুন আবিষ্কারের সাথে থাকে-কি দেশকে দেশের সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া? রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা ক্লেদাক্ত দিকও আছে যাতে- তা’ হলো ক্ষমতায় থাকার জন্যে জনগণকে কিছু ভীতি প্রদর্শন। আমরা জানি ডিসএণ্টিনা আমাদেরকে জগতের সংঘটিত সব কিছু দেখতে উদ্বুদ্ধ করছে সহায়তা করছে- এর মধ্যে আমরা কোনদিকে প্রভাবিত হবো- তার গাইড লাইন দেবে আমাদের দেশপ্রেমিক কবি শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। আজ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা দখলের জন্যে একেক সময় একেক উপসর্গ খাড়া করার কৌশল- আমরা জানি অবশ্যই জানি কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ। নিউগিনি দ্বীপের পাপুয়া রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বের গভীর জঙ্গলের তিনহাজার আদিবাসী ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জানতোই না যে পৃথিবীর আর কোন অংশে মানুষ আছে। ওরা অবশ্য মানুষ খেকো উপজাতি। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে তারা মানুষ খাওয়া প্রায় বন্ধ করেছে- তাদের মানুষ খাওয়া সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া নিশ্চয়ই ইতিবাচক। আমাদের সংস্কৃতির বিচিত্র যন্ত্রণাদায়ক অভিব্যক্তিগুলো বাদ দিলে আমরা এগুতে পারবো। আগেই বলেছি দেশপ্রেমই হলো টিকে থাকার উপায় শুধু আত্মপ্রেম নয়।
৭.তরুণ কবিদের লেখা কি পড়েন? কাদের কবিতা আপনাকে বেশী টানে?
উত্তর: আমি সমসাময়িক তরুণ এবং অগ্রজদের সব লেখা পাঠ করার চেষ্টা করি। ধ্রুপদি সাহিত্যের প্রতি আমার টান প্রগাঢ়। আপনি জানেন আমার মধ্যে ইতিহাসচেতনা এবং পৌরাণিক বিষয়গগুলো ক্রিয়াশীল। তবে সেই সব তরুণদের কবিতা আমার ভালো লাগে যারা সোজাসাপটাভাবে জীবনকে নতুন করে ফিরে দেখে, আবিষ্কার করে এবং নান্দনিকভাবে প্রকাশ করে। যারা মুখের ভাষার কাছাকাছি থাকে। আভিধানিক শব্দ যা আটপৌরে কম্মিনকালেও আনন্দ দেয় না সেই সব যারা ব্যবহার থেকে বিরত থাকে তাদের কবিতা আমার ভালোলাগে। অবশ্য কবিতার শক্তিগুণে অনেক মৃতশব্দও জেগে উঠতে পারে বিস্ময়ের সাথে। জীবনানন্দ এবং আল-মাহমুদের এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে শূন্য কিংবা ১ম ও ২য় দশকের অনেক কবি নতুন উৎপ্রেক্ষ্ াতৈরি করছেন- যা’ আনন্দের এখুনি দু’একজনের নাম বলা যাবে কিন্তু তাতে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হবে।
৮.বিশ্ব সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের তুলনা করবেন কিভাবে?
উত্তর: বাংলা কবিতা বিশ্বমানের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন,শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ,শহীদ কাদরী আন্তর্জাতিকমানের কবিতা রচনা করেছেন।
নজরুল-অগ্নিবীণার জন্য,জীবনানন্দ-রূপসী বাংলার জন্য,শামসুর রাহমান-বিদ্ধস্ত নীলিমার জন্য এবং আল মাহমুদ-সোনালী কাবিনের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনেকাংশে নির্ভর দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওপর। ধনীদেশের কবি সাহিত্যিক যত দ্রুত নোবেল পাবেন-দরিদ্র দেশে পাবেন না- বুর্জোয়া সভ্যতার এই হচ্ছে নির্মমতা।
এটা আশাব্যঞ্জক যে আমাদের কাব্যমান গদ্যের ভাষাশৈলী ক্রমাগত বিশ্বপাঠকের রুচির সমতুল্য হয়ে উঠছে। এখন নেটের কল্যাণে, ওয়েব সাইটের কল্যাণে,গুগলের পৃষ্ঠপোষকতায় পেয়ে যাচ্ছি বিশ্বের কবিতা-পড়ছি বিশ্বের প্রায় সব দেশের সাহিত্য। বাংলা কবিতার ত্বরণ আশাব্যঞ্জক।
৯.আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা লেখালেখিতে কম আসে কেন?
উত্তর: এসব ঘটে শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। নারী ছিলো অন্তপুরবাসী বেগম রোকেয়া,কুসুম কুমারী দাশ,সুফিয়া কামাল,নূরজাহান বেগম,রাবেয়া খাতুন এর মতো নারীরা লেখালেখির সাথে যুক্ত হওয়ার কারনে পালে হাওয়া লাগে। ধীরে ধীরে একটা লেখক সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। এখন অনেক নারী ভালো লিখছে। মাহিলা পাতা নির্ভর নারী সাহিত্য তুলে দিতে হবে। পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য। নারীরা সংসারের শিল্পী-কবিতার শিল্পী হওয়া তাদের জন্যে কঠিন -সে ক্ষেত্রে সংসারের কিছু ভার –কমাতে পারলে তাদের অংশগ্রহণ ও সমৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে ঘটতো-। আর একথাও ঠিক যে লেখক সে লিখবে পড়বে এবং প্রকাশের ব্যাকুলতায় উদগ্র হবে। মার্কিন মুলুকের কবিতায় মায়া এঞ্জেলো এক সংগ্রামী কবি- কানাডায় মার্গারেট এ্যাটউড মহাশ্বেতা দেবী-এদের লেখক হবার ইতিহাসটা আমাদের দেশের নারী লেখকদের পড়ে দেখতে হবে।শুধু নারীবাদী হলে লেখক হওয়া যায় না।
১০.সাহিত্যে গোষ্ঠীবাজী কতটা সাহিত্যের কাজে লাগে বলে মনে করেন?
উত্তর: মহৎ উদ্দেশ্যে যদি কোনো গোষ্ঠী কাজ করে তবে নিশ্চয়ই তা কাজে লাগে। বিশ্বসাহিত্যে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলবে- হাংরি জেনারেশন, কালি ও কলম গোষ্ঠী, অনুশীলন সংঘ,তমুদ্দুন মজলিশ-সওগাত সাহিত্য গোষ্ঠি,অধুনা পদাবলী ও কবিকণ্ঠ এবং জাতীয় কবিতা পরিষদ,ম্যাজিক লণ্ঠন এসবের অনেক ভালো দিক আছে। এসব একেকটা লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক সাহিত্য গোষ্টী তৈরি করে এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের চেষ্টা চালায়। এসব একটা শুভ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। কিছু সাহিত্যিক দলবাজি হানাহানি, দোষারোপ করতে ব্যস্ত থাকে। আশিতে একবিংশ এবং গান্ডীব পত্রিকাদুটি উল্লেখযোগ্য। তবে শুধু দলবাজি দিয়ে লেখক হওয়া যায় না। অবশ্যই লেখককে লিখতে হবে এবং অবশ্যই নতুন কিছু যা আগে কেউ লেখেনি।
১১. কবিতার পাঠক কম এমন একটি বাক্য লোকজনের মধ্যে প্রচলন রয়েছে আসলে এ সংকট থেকে বের হয়ে আসার কি কোন পরামর্শ আপনার কাছে রয়েছে?
উত্তর : এ সংকট চিরকালীন। রবীন্দ্রনাথ তার এক বন্ধুকে লিখেছিল বইয়ের বেচা বিক্রি দেখিও। মধুসূদনের মেঘনাধবধ কাব্য আশাব্যঞ্জক বিক্রি হয়নি। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ লেখক সের্গেই লুইস বোর্হেসের প্রথম বই ৭ কপি কিনেছিলো বন্ধুরা, অন্যদিকে জনপ্রিয় ধারার কথাসাহিত্যিকদের বইয়ের বাজার রমরমা। সস্তা উপন্যাসে বাজার সয়লাব। এদিকে টিভির বস্তাপচা চোরপুলিশ ডাকাত পরকিয়া কাহিনীর সুড়সুড়িতে পাঠক বিভ্রান্ত। তার মধ্যে মহৎ কবির ভালো উৎকৃষ্ট শৈল্পিক কবিতা কেনার দায় কে গ্রহণ করবে? দায় শুধু পাঠকের নয়- কবিকেও এগিয়ে আসতে হবে। একবার ফ্রান্সে গিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় এবং মণিন্দ্র রায় রমা রঁলার সাথে দেখা করতে। তিনি থাকতেন ফ্রান্সের এক গ্রামের ছোট্ট বাড়ীতে । এক পর্যায়ে মণিন্দ্র রমারলাকে জিজ্ঞেস করলেন এখন কবিতা পাঠক আগের মতো পড়ে না কেন? রমা রঁলা উত্তর দিলেন এখনকার কবিতা মানুষের সুখদুঃখ বেদনা ও বিশ্বাসের কথা থাকে না সেজন্য পাঠকরা পড়ে না যদি ভিক্টর হুগো বেঁচে থাকতো তবে কবিতার এই দুর্দিন হতো না। আমি বলবো যোগ্য কবির কবিতায় বই ভালো বিক্রি হয়। অসংখ্য সংগ্রামী মানুষের দেশ, কবির দেশ, স্বাধীন দেশ, নদীর দেশ, প্রায় ৫ হাজার কবির বসবাস তবু যদি বলি কবিতার পাঠক নেই এ দায় কিছুটা কবিদেরও।
১২.বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কবিতার ভবিষ্যৎ কি?
উত্তর: কবিতার ভাবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণদের হাতে। ওরা কতটা কবিতাকে মানুষমুখী পাঠকমুখী করতে পারবে তার ওপরে। রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও কান পেতে আছি সে কবির লাগি জন্ম যার মাটির কাছাকাছি। তবে হতাশার কিছু নেই- কবিতার জয় অবশ্যাম্ভাবী।
১৩.কবিসত্ত্বা ও ব্যক্তিসত্ত্বার মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর: এটি একটি দার্শনিক প্রশ্ন। প্রত্যেক মানুষই ব্যক্তিগত জীবন যাপনের মধ্যে সঞ্চরণশীল। তার ক্ষুধা আছে, চাহিদা লোভ ক্ষোভ আছে, কিন্তু তদসত্ত্বেও নিরাসক্তভাবে জগতকে দেখা। তার মধ্যে বিষয়ের মানদ- এমনভাবে প্রতিস্থাপিত যেন তা ব্যক্তিকে স্পর্শ না করে ব্যক্তিগত জীবনের দিকে পাল্লা না ঝোকে। সংসার থেকেও কবিকে হতে হয় ঋষি। ভোগ করেও কবিকে হতে হয় অভোগী- লোভ থাকলেও কবিকে হতে হয় নির্লোভ।
১৪.মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কি পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিলো আমরা তার কতটুকু পেয়েছি?
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আমাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি আসেনি। স্বাধীনতার শক্ররা তৎপর। এক স্বৈরশাসককে হটিয়ে আরেক স্বৈরশাসক। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসন আর নতুন বোতলে পুরাতন মদ।
যারা ক্ষমতায় আসেন তারা বলেন আমরা তোমাদের ভালোমতো দেখাশোনা করছি। জজ অরওয়েলের এনিমেল ফার্মে পশুদেরকে যেভাবে আশ্বস্থ করা হয় আমরা তোমাদের দেখা শুনা করছি। আমাদের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা তৈরি করতে হবে বুর্জোয়া ব্যবস্থার অপকৌশলগত দিকগুলো বাদ দিতে হবে। আই এম এফ, বিশ্বব্যাংক জাতি সংঘের সুবিধাজনক ব্যবস্থাপত্রের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
১৫.বর্তমান যৌনশব্দগুলো কবিতায় প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছে এসব কবিতার জন্যে কতটা দরকারি কিংবা ক্ষতিকর?
উত্তর:যৌনগন্ধী শব্দ প্রয়োজনে আসতে পারে। অহেতুক পাঠককে উত্তেজিত বা প্রলুব্ধ করার জন্যে এসব শব্দ ব্যবহার লেখকের দুর্বলতা প্রমাণ করে। জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার কিংবা ক্যাম্পে কবিতা, নজরুলের বারাঙ্গনা-কবিতা,আল মাহমুদের-সোনালী কাবিন, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লা, আব্দুল মান্নান সৈয়দের কিছু লেখায় এ ধরণের শব্দ বা ইমেজ আছে। তবে সচেতন থাকতে হবে নিঃসন্দেহে অপসৃষ্টি অপ্রয়োজনীয় যৌনতা নিয়ে। এসবে যারা জড়িয়ে যায় তাদের ভাগ্যে সাহিত্য খ্যাতি জোটে না- জোটে কলঙ্কের তিলক।
১৬. এবার আপনার লেখালেখির খবর জানতে চাই? বর্তমান কি লিখছেন, আসছে ফেব্রুয়ারীতে আপনার কি কি বই আসছে, কোথা থেকে?
উত্তর: আমি সব সময় পঠন পাঠনের মধ্যে থাকতে ভালবাসি। একটা কবিতার মূল কাঠামো অথ্যাৎ ৮০ ভাগ দাঁড়ায় প্রাথমিক খসড়ায় তারপর ২০ ভাগ পরিমার্জনে ব্যয় হয়। একটা ভালো কবিতা লিখতে মাস কিংবা বছর যায়। বর্তমানে ভারত থেকে আসা পর্যটক বঙ্গ বাহাদুর হাতিটি নিয়ে একটা কবিতার থিম দাঁড় করাতে চেষ্টা করছি। শরৎ নিয়ে কয়েকটি কবিতা লিখছি। কারণ ষড়ঋতু বৈচিত্র শুধু লেখায় আছে প্রকৃতিতে নেই, বই মেলায় কবি প্রকাশনী থেকে বেরুবে শেষ্ঠ কবিতা ,কথা প্রকাশ থেকে বেরুবে কাব্যগ্রন্থ তদন্ত রিপোর্ট। আর একটি গদ্যের বই এতে পাবো। আমার বইয়ের পরিকল্পনা বদলে যায়- জানি না বইমেলায় আগে কি হয়। দেশের যা অবস্থা বইমেলাতে সব সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাবিত করে। লেখকরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে না এটা খুবই উদ্বেগের।
১৭.আমাদের দেশের নারীরা কতটা স্বাধীন বলে আপনি মনে করেন? আমাদের দেশে নারী মুক্তির ব্যাপারে আইন কতটা উপযোগী বা ধর্ম কতটা তাদের মুক্তির ব্যাপারে প্রভাব ফেলছে বা বাধা সৃষ্টি করছে?
উত্তর: নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে আশাপ্রদমাত্রায়। শিক্ষার হার বাড়লে নারীরা মুক্তির স্বাদ পাবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজে অংশ গ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের বড় জায়গা। শুধু বাংলাদেশে নয় এশিয়ার প্রায় সবদেশে নারীর উন্নয়ন ঘটছে। শুধুমাত্র ধর্মান্ধতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আফগানিস্তান সিরিয়া,ইরাক লিবিয়া এমনকি পাকিস্তান ও ভারতেও ধর্মান্ধতা একটা বড় বাধা। ধর্মের ভালো ফজিলতগুলো নারীর সামনে তুলে ধরতে হবে শুধুমাত্র খারাপ দিকগুলো আবার ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের যে পুঁজিবাদী ধারনা থেকে উত্তরণের জন্য নান্দনিক কার্যক্রমে-শিক্ষায় শিল্পসাহিত্যে আর্ত মানবতার সেবায় নারীকে যুক্ত হতে হবে।
১৮.আপনার দীর্ঘ সাহিত্য যাত্রায় সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে জানতে চাই?
উত্তর: দীর্ঘ সাহিত্য যাত্রা সিঃসন্দেহে স্বল্পায়ুর জীবনে ৪ দশকের সাহিত্য সাধনা কম নয়। উল্লেখের দাবি রাখে এমন কিছু আছে কিনা পাঠক বলতে পারবে। আমার ৪০টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ফিরিনি অবাধ্য আমি, আশ্চর্য আয়নাগুলো, আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে, ভাঙা দালানের স্বরলিপি, সবজন্মে শক্র ছিলো যে, জমজ সহোদর, বায়োডাটা, জ্যামিতি বাক্রের গল্প, উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ-আরোগ্য, নজরুলের আত্ম-নৈরাত্ম, ছড়ার বই- হাঁটতে থাকো, চাবুক, সাক্ষাৎকার গ্রন্থ প্রশ্নের পুরাণ ও একুশ প্রশ্ন এক উত্তর উল্লেখযোগ্য আমি বোর্হেসের সেই কবিতার লাইন মনে প্রাণে বিশ্বাস করি একজন সৃষ্টিশীল লেখকের গন্তব্য অনিঃশেষ।
১৯.একজন সাহিত্য কর্মীর জীবনে পুরষ্কার কতটা প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন?
উত্তর: একজন কবি সাহিত্যিক লেখকের জীবনে পুরষ্কার অর্থহীন নয়। তা নতুন প্রেরণা তৈরি করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার প্রায় আশি বছর নতুন নতুন সৃষ্টিতে ক্রিয়াশীল ছিলেন। যথাযোগ্য পুরষ্কার যদি হয় –তবে তা’ লেখকের জন্য প্রেরণাদায়ী। বড় পুরষ্কার লেখককে সামাজিকভাবে সম্মানিত করে। আমি মনে করি যোগ্যশ্রমের যোগ্যকাজের স্বীকৃতি আবশ্যক। আমাদের দেশে মৃত্যুর পরে যে মূল্যায়ন করা হয় তা কাজে আসে না। যদি লেখক জীবদ্দশায় তা পেতো তবে তার আত্মতৃপ্তি থাকতো- যদিও আমি মনে করি লেখক হবেন অতৃপ্ত। একটা কবিতায় এজন্যে লিখেছি-
যে অন্ধ সে অতৃপ্ত
যে তৃপ্ত সে মৃত।

২০.অনেক ধন্যবাদ
উত্তর: সাক্ষাৎকারে একজন লেখকের অনুভবের জগৎ ধরা পড়ে। আমি সাক্ষাৎকার পাঠ করতে পছনকরি। আপনাকে ধন্যবাদ।