`শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন যে প্রাক্তন বিচারপতিরা ‘

আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২৩
0

অলিউল্লাহ নোমান

মতিন সাহেবরাই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদি হয়ে উঠতে সব রকমের সহযোগিতা করেছিলেন। এই মতিন সাহেব তখন আপিল বিভাগের বিচারকের আসনে ছিলেন। আপিল বিভাগের বিচারকের আসনে বসে বলেছিলেন-“ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স”।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সিনিযর সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান ভেরিফায়েড ফেসবুকে তিনি এভাবেই লিখেছেন। তার লেখাটি হুবুহু দেশ জনতা ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ————-
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন মতিন সাহেবরাই (দু:খিত তাঁর নামের আগে “বিচারপতি” শব্দটি ব্যবহার করে এই শব্দের অবমাননা করা থেকে বিরত থাকলাম) গড়ে দিয়েছিলেন—-
মতিন সাহেবের এই বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানাই। এখন তাঁর উপলব্ধি হয়েছে।

আমি যতদিন বেঁচে থাকবো মতিন সাহেবের এই উক্তি আমার কানে বাজবে। কারণ, তাঁর এই দাম্ভিকতাপূর্ণ উক্তির শিকার আমি।
সেদিন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আপিল বিভাগের ৬ বিচারক রীতিমত নাজেহাল করেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের এক নম্বর আপিল আদালত আইনজীবীতে ঠাসা ছিল। কেউ প্রতিবাদ করেননি। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখেছেন। মতিন সাহেবরা সেদিন যেন ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বসেছিলেন।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে প্রথমেই বিচার বিভাগ কব্জায় নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এনিয়ে একটি অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলাম ২০১০ সালের এপ্রিলে। রিপোর্টটি লেখার পর সম্পাদক মহোদয় শিরোণাম ঠিক করেছিলেন। শিরোণামটি ছিল-“চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে”।
এই নিউজের মূল অনুসন্ধান ছিল সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালতের বেআইনি আদেশ নিয়ে। হইকোর্ট বিভাগ তখনো পুরোপুরি শেখ হাসিনার কব্জায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন বেঞ্চ থেকে আইন অনুযায়ী আদেশ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে চেম্বার আদালতে গিয়ে স্থাগিতাদেশ চাইতো। কোন ন্যায়-অন্যায় যাছাই ছাড়াই হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ স্থগিত করা হত। এনিয়ে ছিল মূল প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনটিতে অনেক গুলো মামলার উদাহরণ দেওয় হয়েছিল। যে গুলোতে চেম্বার জজ আইনের তোয়াক্কা না করেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল।
আমাদের এই রিপোর্টের পর আদালত অবমাননার নোটিশ করেছিল আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগ এ ধরনের নোটিশ করলে সবাই ক্ষমা চায়। ব্যারিষ্টার রফিক উল হক থেকে শুরু করে সিনিয়র আইনজীবীরা আমাদেরকেও ক্ষমা চাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার দেশ সম্পাদক তাদেরকে মুখের উপর বলেছিলেন, আমার রিপোর্টার ভুল তথ্য দিয়ে খবর পরিবেশন করেনি। সুতরাং ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা ভুল বা মিথ্যা কিছু লিখিনি। আমরা মোকাবিলা করব।
এতে কোন আইনজীবী আমাদের পক্ষে আপিল বিভাগের সামনে দাড়াতে রাজি হলেন না। সম্পাদক মহোদয় বললেন, তিনি নিজেই শুনানী করবেন। আগেই তাঁকে অন্য মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখন তিনি কারাগারে ছিলেন। কারাগার থেকে তাঁকে আপিল বিভাগে আনা হল। মামলার শুনানীর জন্য তিনি দাড়ালেন। তাঁকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয়েছিল সেদিন। টানা পরপর দুই দিন শুনানী হয়েছে। দুই দিনই তরা সম্পাদক মহোদয়কে নানা প্রশ্ন করেছেন। এমনকি রিপোর্টের প্রসঙ্গে নয়, ব্যক্তিগত আক্রমন করেছেন। সিনহা সাহেব এক পর্যায়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠেছিলেন-“আপনি নিজেকে কি মনে করেন?”
৬বিচারকের মধ্যে মতিন সাহেবকেই সেদিন সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত দেখা গেছে। নানা প্রশ্নবানের মধ্যেই আমার দেশ-এর রিপোর্টের পক্ষে সম্পাদক মহোদয় ডকুমেন্টস উপস্থাপন করলেন। নিয়ম অনুযায়ী ৬ বিচারকের হাতে ডকুমেন্টস গুলো তুলে দিলেন বেঞ্চ অফিসার। ডকুমেন্টস হাতে নিয়ে না দেখেই মতিন সাহেব উত্তেজিত কন্ঠে বললেন-“এখানে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স”। সাথে সাথে প্রধান বিচারপতির আসনে বসা ফজলুল করিম বললেন-“আমরা এখানে সত্য-মিথ্যা যাছাই করতে বসিনি!”
শাহ আবু নাঈম বলেছিলেন-“সভ্যতা ভব্যতা বলে একটা কথা আছে।” সিনহা সাহেব-এতে সায় দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলেছিলেন-“আমরা এসব দেখব না। আমরা দেখব আদালতকে অবমাননা করা হয়েছে কি না।”


খায়রুল হক তো ছিল আরো উত্তেজিত।
সত্য-মিথ্যা যাছাই না করে তারা আমাদের জেল জরিমানা করলেন। তাও আবার আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে। আইনে বলা আছে আদালত অবমাননার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি-অনুর্ধ ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং অনধিক ২০০০ টাকা জরিমানা। তারা আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি সম্পাদক মহোদয়কে ১ লাখ টাকা এবং আমাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। এই বেআইনি জরিমানা আমরা পরিশোধ করিনি। অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাভোগ করেছি।
মাস খানেক পরই ফজলুল করিম অবসরে যাবেন। প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা মতিন, শাহ আবু নাঈম ও খায়রুল হকের মধ্যে। সারাদিন আমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা দেখিয়ে জেল জরিমানার পর রায়টি লেখার দায়িত্ব নিলেন মতিন সাহেব। কারণ আপিল বিভাগে একজন রায় লিখেন। বাকীরা দেখে স্বাক্ষর করেন অথবা ভিন্নমত থাকলে নিজের অভিমত গুলো লিখে স্বাক্ষর করেন।
আমাদের রায়ের পর মতিন সাহেব রাতের বেলায় মুজিব কোট গায়ে লাগিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রিদের বাসায় গেছেন প্রধান বিচারপতি হওয়ার তদবীর করতে। তারপরও ভাগ্যের চাকা উল্টা দিকে ঘুরেছে। প্রধান বিচারপতি আর হতে পারেননি। শেখ হাসিনার পছন্দ তখন খায়রুল হক। মতিন সাহেব পরবর্তীতে আর আমাদের বিরুদ্ধে রায়টি না লিখে ফাইল ফেরত দিলেন। শেষ পর্যন্ত সিনহা সাহেব এক বছর পর রায় লিখেছিলেন। রায় লেখার আগেই আমরা কারাভোগ করে মুক্তি পেয়ে গেছি।
মতিন সাহেবরা যতবারই এরকম লোক দেখানো আইনের শাসনের কথা বলবেন, ততবার আমি তাদেরকে সেই দিনের ঘটনা ষ্মরণ করিয়ে দেব। কারণ, তারাই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন। এখন এসব বলে মানুষের মন থেকে অতীত ভোলাতে চাচ্ছেন।
প্রধান বিচারপতি না বানালেও শেখ হাসিনা মতিন সাহেবদের নানাভাবে পুরস্কৃত করেছেন। অবসরের পর শ্রম আদালতের বিচারক বানিয়ে সরকারি বাড়ি-গাড়ি দিয়েছিলেন বহুদিন।