সবুজ সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে এলো আষাঢ়

আপডেট: জুন ১৬, ২০২৩
0

সবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে এসেছে আষাঢ়। আকাশ ছেয়েছে মেঘের ঘনঘটায়। মেঘদূতের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে পহেলা আষাঢ়। গাছের পাতা, টিনের চাল কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে এবং খোলা আকাশের প্রান্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার দিন। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার অঙ্গন আষাঢ়বন্দনায় নিবেদিত, উচ্ছ্বসিত। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারে বর্ষার অপরূপা রূপবর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত চিরকালীন হয়ে আছে।

বর্ষা কবি-সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোনো কবি নেই যিনি কি-না বর্ষা নিয়ে এক-দু’লাইন লেখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ, বর্ষা-বৃষ্টি এসব শব্দ কবিদের ভাবের জগতে বুঁদ করে, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে, হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন।

আষাঢ় নিয়ে কবিতায় নজরুল আষাঢ় মাসকে কিভাবে চয়ন করেছেন প্রয়োগ করেছেন তা নি¤েœর উদ্ধৃতিগুলো থেকে বুঝা যাবে। বেশ কিছু কবিতায় এই আষাঢ়কে কবি চমৎকারভাবে সাজিয়েছেন- ‘ইন্দ্রপতন’-এ নজরুল দারুণ বর্ণনায় আষাঢ়কে উপস্থাপন করেছেন- আষাঢ় মাসের এটাই বাস্তব-রূপ-আগমন-

তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু

অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরু গুরুগুরু!

আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?

শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃত্তহিত-ধ্বনি।

বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,

সাজিল প্রথম আসাঢ় আজিকে প্রলয়ঙ্কর সাজে।

—ইন্দ্র পতন


বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান

দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাস্॥

বলেন, ‘হাঁদা। ক্যাবলাকা-! চাষাড়ে।

গপপ করতে ঠাঁই পাওনি চন্ডুখরি আষাঢ়ে

দেবো নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে?

— খোকার গপপ বলা

আজ আষাঢ়-মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মু’খানি ঢাকি

আহা কে তুমি জননী কার নাম ধরে বারে বারে যাও ডাকি?

মাগো কর হানি দ্বারে দ্বারে

তুমি কোন হারামণি খুঁজিতে আসিলে ঘুম-সাগরের পারে?

–সত্যেন্দ্র প্রয়াণ

চোখে জল আসে, হে কবি-পাবক, হেন অসময়ে গেলে

যখন এ দেশে তোমারি মতন দরকার শত ছেলে।

আষাঢ়-রবির তেজোপ্রদীপ্ত তুমি ধূমকেতু-জ্বালা,

শিরে মনি-হার, কণ্ঠে ত্রিশিরা ফনি-মনসার মালা

–সত্য-কবি

barsha

-আজিও তেমনি করি

আষাঢ়ের মেঘ ঘনায়ে এসেছে

ভারত-ভাগ্য ভরি।

আকাশ ভাঙিয়া তেমনি বাদল

ঝরে সারাদিনমান।

দিন না ফুরাতে দিনের সূর্য

মেঘে হলো অবসান।

—তর্পণ

আজি আষাঢ়ের বজ্র-গর্ভ নবীন নীরদ-সম

গরজি উঠুক, হে স্বদেশ, তব মন্ত্র নবীনতম!

আনো খরতর প্রাণদা বন্যা, আনো পশ্চিমি হাওয়া-

টানি লয়ে যাও কঠোর সমুখে, ভোলাও পিছনে চাওয়া।

—স্বদেশ

আমি মরু-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান,

যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।

জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্রসুখে

সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে!

আষাঢ়ের গিরি-নিঃ¯্রাব-সম কোনো বাধা মানিল না,

বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমণা,

কূপম-ুক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে,

তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।

–জীবন বন্দনা

বর্ষা বলে অশ্রুজলের মানিনী সে বিরহিনী।

আকাশ বলে, তড়িত লতা, ধরিত্রী কয় চাতকিনী।

আষাঢ় মেঘে রাখলো ঢাকি

নাম যে তোমার কাজল আঁখি,

শ্রাবণ বলে, জুঁই বেলা কি?

কেকা বলে মালবিকা।

–অ-নামিকা

বার্ধক্য ও যৌবন (যৌবনের গান) প্রবন্ধটি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সাহেবের এলাকা সিরাজগঞ্জে এসে একটি ভাষণের অংশ। মূল্যবান এই ভাষণ তরুণদের জন্য অনেক উপদেশ-বাণী রয়েছে। সেখান থেকেই এই অংশটুকু উদ্ধৃত করছি-

ক্স বহু যুবককে দেখিয়াছি- যাঁহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কালমূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি, যাঁহাদের বর্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘ-লুপ্ত সূর্যের মত প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার যাহার শক্তি অপরিমাণ।, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মার্ত-প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরান্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসাগরের সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-জগলুল-মানইয়াত-লেলিনের শক্তিতে।

— বার্ধক্য ও যৌবন (যৌবনের গান

তাইতো রবীন্দ্রনাথ তার ‌‘আষাঢ়’ কবিতায় লিখেছেন-

“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।”

বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দুমাস বর্ষা ঋতু। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ রূপ বদলায়। বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন। আষাঢ় মানেই যেন মেঘবতী জলের মৌসুম। বর্ষার বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের হাসি তো ভুবন ভোলানো! কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে।’

কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন :

‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’’

চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এই বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরো বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘবৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারণ করে- ভাষার সাধ্য কি পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রং রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্ত কাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায়। বর্ষা বন্দনায়।