সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিনের মৃত্যুতে আমরা অভিভাবক শূণ্য হয়েছি–শওকত মাহমুদ

আপডেট: ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
0

প্রবীন সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে অশ্রুসজলে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে সাংবাদিকরা।

রোববার সকাল ১১টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মরহুমের কফিন জাতীয় প্রেসক্লাবের টেনিস কোর্টে আনার পর কালো কাপড়ে ঘেরা একটি অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয়। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা শ্রদ্ধা জানায় ফুলের স্তবক দিয়ে।মরদেহের চারপা্শে শুধু সাংবাদিক নয়, নানা শ্রেনী-পেশার মানুষের অশ্রুসজল ফুলে ফু্লে ভরে যায়।

কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর নয় দিন আগে রিয়াজ উদ্দিনকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছিলো। শনিবার দুপুরে হাসপাতালে চিকিতসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ কয়েকবার সাংবাদিকদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আবার নবীর অনেক সাংবাদিকরা তাকে তাদের ‘বাতিঘর’ হিসেবে মনে করো। নানা সংকটে সাংবাদিক-কর্মচারিরা তার কাছে ছুটে যেতেন সমাধানের পথ খুঁজতে।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে মাশরুর রিয়াজ জানান, বাবার মরদেহ হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নরসিংদীতে গ্রামের বাড়ি নারান্দীতে। সেখানে বাদ জোহর নামাজে জানাজা শেষে হেলিকপ্টারে করে আবার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে।

এরপর বাদ আসর বারিধারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে বিকালে বনানীতে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে।

জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথম নামাজে জানাজায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিল্প মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেলন হোসেন, নিউ এজের প্রকাশক এসএসএম শহিদুল্লাহ খান, এডিটরস গিন্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, শওকত মাহমুদ, সাইফুল আলম প্রমূখ অংশ নেন।

এছাড়া জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শাহজাহান মিয়া, স্বপন সাহা, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এম এ আজিজ, বদিউল আলম, গোলাম মহিউদ্দিন খান, আবদুল হাই শিকদার, রফিকুর রহমান, এলাহী নেওয়াজ খান, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হাই সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এম আবদুল্লাহ, নুরুল আমিন রোকন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কাদের গনি চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের শাহেদ চৌধুরী, মাইনুল আলম, আশরাফ আলী, কাজী রওনাক হোসেন, বখতিয়ার রানা, কাদির কল্লোল, লোটন একরাম, বিএনপির শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আকরামুল হাসান, শামসুদ্দিন দিদার, ন্যাপের গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়াসহ রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।

‘রিয়াজ ভাইয়ের বিদায় অপুরণীয়’

জানাজার আগে ক্লাবের টেনিস কোর্ট প্রাঙ্গনে প্রয়াত রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের কফিনের সামনে রেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ শাহেদ চৌধুরীর পরিচালনা এতে ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে প্রয়াত রিয়াজ রহমানের ভাই অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল জয়নাল আবেদনী ও মরহুমের একমাত্র ছেলে মাশরুর রিয়াজও ছিলেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘‘ তার এই মৃত্যু অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে সাংবাদিকতার পেশায়।”

‘‘পৃথিবীতে শূণ্যতা থাকে না। হয়ত উনাকে হারানো যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা এখনই পুরণ হবে না। তবে উনার ভালোর গুনগুলো আমাদের সকলের স্মরণ রাখা দরকার। তার সাহস, দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ঠতা, সাংবাদিক শ্রেনীর জন্য্ তার দরদ-অবদানকে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ‘‘রিয়াজ ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের সকলের জন্যই বেদনার কষ্টের। উনি সেই সাংবাদিক যিনি গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে, তার মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে সবসময় সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।”

‘‘ আমি মনে করি, এই সময়ে যখন গণতন্ত্রের একটা সংকট চলছে তখন তার মতো সাংবাদিকের খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে তার একটা বড় শূণ্যতা অনুভব করছি। তার বিদাহী আত্মার আমি শান্তি কামনা করছি।”

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘‘ আমি রিয়াজ ভাইয়ের পরোলোকগমনে অত্যন্ত মর্মাহত, ব্যাথিত। আমি উনারকে খুব মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করতাম। উনি আমাদের সম্পাদক পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। উনার সঙ্গে অনেক সাংবাদিকদের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, সাংবাদিকদের একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি আন্দোলন, অনেক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সাথে আমার থাকবার সুভাগ্য হয়েছিলো। আমি উনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। উনারকে আল্লাহ যেন বেহেস্ত বাসী করেন।”

‘‘ রিয়াজ ভাইয়ের য়ে একটা খুবই উদার মনোভাব, সবার সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করার একটা স্বভাবসুলভ গুন ছিলো আমরা যেন সেই গুন আমাদের মধ্যে আনতে পারি। উনার সাংবাদিকতার মূল্যবোধকে আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা নিজেরাও যেন আরো অধিকতরস্তরের সাংবাদিক হতে পারি এই প্রত্যাশা রইল।”

নিউজ পেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘‘ রিয়াজ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের তবে ঘনিষ্টতা খুব বেশি দিনের না। যেভাবে আমি দেখেছি একজন পেশাদারী সাংবাদিক হিসেবে যতগুলো গুন থাকা দরকার আন্তর্জাতিক লেভেলে এবং দেশীয় লেভেলে প্রত্যেকটা গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরবর্তি সময়ে তিনি নোয়াবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।”

‘‘ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে যখনই কোনো কিছু আমাদের কাছে আসতো তখনই আমরা রিয়াজ ভাইকে দায়িত্ব দিতাম নোয়াবের সাথে সাংবাদিকদের একটা সমন্বয় করার জন্য এবং তাকে এটাও বলতাম আপনি কিন্তু সাংবাদিকদের পক্ষ নিয়েন না, আপনি নিরপেক্ষ থাইকেন। উনি কিন্তু নিরপেক্ষভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি বলব, রিয়াজ সাহেবের জীবনের যে উল্লেখযোগ্য অবদান এই প্রেসক্লাবের জন্য, সাংবাদিকদের জন্যে, সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্যে নতুন প্রজন্ম যেন তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহন করি যে, রিয়াজ ভাইয়ের আদর্শকে যেন আমরা ধারণ করতে পারি। তিনি আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শওকত মাহমুদ বলেন, ‘‘ রিয়াজ ভাই তার সাংবাদিকতার চৈতন্যবোধ দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে যখন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন তখন আমিও তার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছি যে, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে মর্মত্ববোধ, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ, সর্বোপরি গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা জন্য তার যে ভুমিকা তিনি তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন।আজকে আমরা অভিভাবক শূণ্য হয়ে গেছি।”

‘‘ তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন- সাংবাদিকদের অধিকার, জনগনের অধিকার এসব মিলিয়ে সাংবাদিকতার পেশার প্রতি তার দায়িত্ববোধে এমন এক ভুমিকা পালন করেছেন যে, তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ‘‘ রিয়াজ ভাই একজন ভালো সংগঠন ছিলেন, ভালো অভিভাবক ছিলেন। পেশার প্রতি তার যে আত্মনিবেদন তার কোনো তুলনা নেই। সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে কখনো তিনি আপোষ করেন নাই।”

‘‘ সাংবাদিক-কর্মচারির স্বার্থের প্রতি তিনি সবসময়ে অবিচল ছিলো। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মতানৈক্য কখনোই মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে না এটা আমরা রিয়াজ ভাইয়ের কাছে থেকে শিখেছি। মতানৈক্য থাকতেই পারে কিন্তু সেখানে দূরত্ব নাই। সেই মতানৈক্য গ্রহন করা, মতানৈক্য নিয়ে আলোচনা করার মানসিকতায় তিনি আমাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করেছেন সারাজীবন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘‘ আমাদের অভিভাবক, শুধ অভিভাবক বললে ভুল হবে আমাদের অভিভাবকের উপরে যদি কিছু থাকে আমাদের অত্যন্ত প্রিয়জন রিয়াজ ভাইকে নিস্তব্ধ নিথর রেখে আজকে আমরা কথা বলছি এটা আমরা কয়েকদিন আগেও আমরা ভাবতে পারিনি। কয়েকদিন আগেও উনি এসে রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন।”

‘‘ আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি যে আমাদের যেকোনো সংকটে আমরা যার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, তিনি আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন আমরা তেমন একজনকে হারিয়েছি। সাংবাদিক সমাজ যেমন অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, জাতীয় প্রেসক্লাব ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং আমরা যারা কমিটিতে আছি ক্লাব পরিচালনা করি আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। তার সম্পর্কে কেউ কোনো নেতিবাচক কথা আমি বিশ্বাস করি জেনেছি, দেখেছি যে, কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। উনি এতো অমায়িক এতো ভদ্র এবং সাংবাদিকতার আমরা যেটাকে বলি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এসব বিষয়গুলোতে উনি যতটা মনোযোগ দিতেন সেগুলো আমরা দারুণ ভাবে মিস করবো, আমরা আমাদের অভিভাবককে মিস করবো। সাংবাদিকতা জগতে তার যে অভাব সেটি পুরণ হবার নয়।”

গত বছরের করোনা সংক্রামণ শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ারসহ ৩৯ জন সদস্য এবং গতকালও আরো একজন সদস্য সৈয়দ আকরামের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তাদের আত্মার মাগফেরাতও কামনা করেন ক্লাব সভাপতি।

জানাজা শেষে জাতীয় প্রেসক্লাব, সম্পাদক পরিষদ, এডিটরস গিল্ড, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, নোয়া্ব, ওকাব, পিআইবি, ডিইউ-৬৭ ক্লাব, জাতীয় প্রেসক্লাব কর্মচারি ইউনিয়ন, সমকাল, নিউজ টুডে প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়াত সাংবাদিকের কফিনে পুস্প স্তবক অর্পন করা হয়।

অর্ধ শতকের সাংবাদিকতা জীবনে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক, ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদক ও নিউজ টুডের সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।