সাফারী পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসকে বদলী

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২২
0

গাজীপুর সংবাদদাতাঃ গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে চলতি মাসে ১১টি জেব্রা ও একটি বাঘ মৃত্যুর ঘটনায় ওই পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান ও ভেটেরিনারী চিকিৎসক ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকারনাইনকে পার্কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে বন অধিদপ্তরে সরিয়ে নেওয়া হয়। সোমবার প্রশাসনিক আদেশে এটি কার্যকর করা হয়েছে। সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী।

বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে চলতি জানুয়ারি মাসে ১১টি জেব্রা ও ১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। জেব্রা ও বাঘের মৃত্যু কারণ জানতে ইতোমধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত কাজ সঠিক ভাবে করতেই এ পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান ও সাফারী পার্কের ভেটেরিনারী অফিসার ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকা্রনাইনকে বন অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। তারা স্বপদে বহাল রেখে তদন্ত সৃষ্ঠু হবে না। তবিবুর রহমানের স্থলে ফরিদপুর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলামকে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ডাঃ হাতেম সাজ্জাদ মোঃ জুলকা্রনাইনের স্থলে কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা এলাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ভেটেরিনারী অফিসার ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

সূত্রে জানাগেছে, চলতি জানুয়ারি মাসে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের ১১টি জেব্রা ও একটি বাঘের মৃত্যুর ঘটনায় পার্কে কর্মরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দায়িত্বে চরম অবহেলার অভিযোগ উঠে। পার্কে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ, সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে প্রাণীর খাবার পাচার, জেব্রা ও বাঘ মৃত্যুর ঘটনা গোপন রাখা এবং জেব্রাগুলোকে হত্যার অভিযোগ এনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ সহ বিভিন্ন মহল থেকে তাদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উঠায় ৩১জানুয়ারি তাদের পার্কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির জানান, গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে পার্কের ৩১টি জেব্রার মধ্যে ১১টি জেব্রা পর্যায়ক্রমে মারা যায়। এরমধ্যে ৬টি জেব্রা ২ জানুয়ারি এবং ২টি জেব্রা ২৮ জানুয়ারি মারা যায়। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাদী জেব্রা। এ পার্কে জন্ম নেয়া জেব্রাগুলোর মৃত্যু বেশি হয়েছে। এদিকে গত ১২ জানুয়ারি পার্কের ১০টি বাঘের মধ্যে একটি পুরুষ বাঘ হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর কারণ জানতে মৃত জেব্রা ও বাঘের শরীরের নমূনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ল্যাবে পাঠানো হয়। জেব্রার মৃত্যুপ্রতিরোধে জরুরী চিকিৎসা এবং এ ধরনের অসুস্থতার কারণ উদঘাটনে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা ১০দফা সুপারিশ দিয়েছে। এদিকে জেব্রাগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং করণীয় বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত পঁাচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।

তিনি জানান, জেব্রা মৃত্যুর কারণ বিশেষজ্ঞরা এখনো সুনির্দিষ্ট করতে পারে নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেস্টে নিউমোনিয়ার সিমটম আসছে। ২৫ জানুয়ারির মধ্যে মৃত ৯টি জেব্রার মধ্যে ৪টি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ইনজুরির কারণে এবং অপর ৫টি জেব্রা অতিরিক্ত কঁাচা ঘাস ছাড়াও স্ট্রেপ্টোকক্কাস, ই-কোলাই, ক্লস্টোডিয়াম, সালমোনিলা ও পাস্টুরেলা নামক ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের (ইনফেকশনাল ডিজিজে) কারণে মারা গেছে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সবুজ ঘাস (ভুট্টা গাছ) নাইট্রোজেন কি পরিমাণে বা সহনীয় পর্যায়ে ছিলো কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২৮ জানুয়ারি দুইটি জেব্রার মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছে বিশেষজ্ঞ দল।

তিনি আরো জানান, পার্কের প্রাণীগুলোকে সরবরাহ করা খাবার গুলো মূলত ফিজিক্যাল এক্সমিনেশন করা হয়। কেমিক্যাল পরিক্ষার কোন ফ্যাসিলিটি নেই এখানে। তাছাড়া ঠিকাদারদের সব সময়ই বলা হয় ভালো খবার সরবরাহ করার জন্য। তারপরেও খাবার গুলোর মধ্যে কোন কেমিক্যাল বা অন্যকোন কিছু আছে কি-না ল্যাবের ফলাফল পাওয়ার আগে তা বলা যাবে না।

নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্কের একাধিক ব্যক্তি জানান, জেব্রার যে খাবার গুলো দেয়া হয় তার মধ্যে ভুট্টা গাছগুলো আনা হয় মানিকগঞ্জ থেকে। এছাড়াও দানাদার খাবার গুলো কেনা হয় গাজীপুর মহানগরীর বাইপাসসহ স্থানীয় বাজারগুলো থেকে। এসব হাতে নিয়ে চোখে দেখেই এর মান যাচাই করা হয়। তবে খাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কোন প্রকার ল্যাবটেষ্ট বা কেমিক্যাল টেস্ট না করেই প্রাণীগুলোকে খেতে দেওয়া হয়। তাছাড়া জেনেটিক কারণে জেব্রার প্রাণি গুলোর আলাদা পরিচর্যার প্রয়োজন থাকলেও সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ছিল এ ক্ষেত্রে।

পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান দায়িত্বে অবহেলার কথা অস্বীকার করে জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটি জেব্রা গুলো মৃত্যু প্রাথমিক কয়েকটি কারণ নির্ধারন করেছেন। এতে প্রাণিদের মধ্যে মারামারি এবং পানিতে ও মাটিতে থাকা চার রকমের ব্যাকটেরিয়ার মিক্স ইনফেকশনের কথা বলা হয়েছে। আফ্রিকা থেকে যে জেব্রা নিয়ে আসা হয়েছিল তার থেকে আমরা যে বাচ্চা গুলো পেয়েছি সেগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক হবে না। যেহেতু প্রাণিগুলো জেনেটিক্যালি দূর্বল খুব সহজে যেকোন ভাইরাস আক্রমন করতে পারবে। এই ধরনের জীবাণুর বাহক হচ্ছে বানর। বানরের প্রস্রাব-পায়খানার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ও টিবি রোগর ছড়িয়ে থাকে। বানর গুলো যেখানে খায় সেখানেই মাঝে মধ্যে পায়খানা-প্রস্রাব করে। সেগুলো সব সময় পরিস্কার করা হয় না। কোর সাফারির ভেতরে উন্মুক্ত স্থানে জেব্রার খাবার দেওয়া হয়। পার্কের ভেতরে প্রচুর পরিমাণ বানর রয়েছে। জেব্রা আর বানরের দল একই সাথে এক জায়গায় খাবার খায়। একই জায়গায় বানর ও জেব্রা খাবার খাওয়ার কারণে বানরের দেহ থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে কিনা সেটাও দেখা হচ্ছে।

এদিকে, সোমবার বিকেলে পার্ক পরিদর্শনে যান গাজীপুরের সদ্য যোগদান করা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি রবিবার কাজে যোগ দেন। উর্দ্ধতন কতর্ৃপক্ষের নির্দেশে জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিতে থাকবেন। পরিচালন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনা যায় কিনা সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তিনি সোমবার পার্ক পরিদর্শন করেন।