সি এস ডব্লিউ এর ৬৫ তম অধিবেশনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে অনলাইনে প্যারালাল ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

আপডেট: মার্চ ১৯, ২০২১
0

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অফ উইমেন (সিএসডব্লিউ) – এর ৬৫ তম অধিবেশনে ”Rape is a crime against Humainity: Impact of Covid-19 Pandemic” বিষয়ক প্যারালাল ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে।

ইভেন্টে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভায় আরো আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. তানিয়া হক; ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি বিভাগের ডিরেক্টর আন্না মিনজ; সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম এবং আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা ।

সভার শুরুতে কী-নোট পেপার উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি বলেন বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার পরিসংখ্যন অত্যন্ত হতাশাজনক।জাতিসংঘ নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার উত্থানকে “ছায়া মহামারী” হিসাবে অভিহিত করে এবং সহিংসতা বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়ার কথা বলে। এসময় তিনি বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিবেচনা করে যে ধর্ষণ হ’ল নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতার নৃশংস প্রকাশ যা তাদের মানবাধিকার হুমকিস্বরূপ।সংগঠন ধর্ষণের ঘটনায় দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সমন্বিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্বরোপ করে।এসময় তিনি কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের শ্রমজীবী নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিষয়ে সংগঠন থেকে পরিচালিত একটি সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করে বলেন বিপুল সংখ্যক মহিলা তাদের পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য খাত থেকে চাকরি থেকে হারিয়েছেন। তাদের অনেকে উপার্জন হারিয়েছে। শ্রমজীবী নারীদের চাকুরি হারানোর ফলে তাদের উপর সৃষ্ট প্রান্তিকীকরণ অবস্থা ধর্ষণ সহ বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।এসময় সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাদের সহায়তা দিতে সংগঠনের ভূমিকার কথা তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন মহামারী শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ (বিএমপি) অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা থেকে বেঁচে থাকা নারী ও কন্যাদের আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য হটলাইন নাম্বার চালু করা হয়, স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়া হয়, রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে, মিডিয়া ক্যাম্পেইন করেছে ,সংস্থাটি বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা আনতে এবং ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বিচারের দাবি করেছে। এছাড়াও নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থ এবং বেঁচে থাকা ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদানের জন্য ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার (ভিএসসি), থানা এবং স্থানীয় প্রশাসনের মতো সরকারী সংস্থাগুলির সাথে মহিলা পরিষদ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং সহযোগিতা বজায় রেখেছে বলে উল্রেখ করেন। এসময় তিনি নারীর ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য মোট ২০টি সুপারিশ তুলে ধরেন।
সভায় বক্তারা বলেন
যেকোনো দূর্যোগে নারীর অবস্থা হয় আরো নাজুক।করোনা পরিস্থিতিতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। করোনাকালীন সময়ে নারীরা ঘরে অবস্থান করলেও সেখানে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছে।ধর্ষণের মূল কারণ ক্ষমতা কাঠামোয় পুরুষের আধিপত্য, সমাজে প্রচলিত বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্ষণের ঘটনায় সহিংসতার শিকার নারীকে সামাজিকভাবে দোষারোপ, ধর্ষণের ঘটনার বিচারে বিলম্ব, সহিংসতার ঘটনায় মেনে নেয়া, আপোষ করা, সাক্ষী খুঁজে না পাওয়া এবং সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে দেয়া সহিংসতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। দেখা গেছে মাত্র ২% ঘটনার বিচার হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে নানা আইন হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারী আইনী সহায়তা পাওয়ার পরিবর্তে হয়রানির শিকার হচ্ছে।ধর্ষণ সহ সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে এসময় বক্তারা বলেন নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় করোনাকালে ইর্মাজেন্সি রেসপন্স আরো জোরদার করতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গণ সচেতনতা তৈরি করতে হবে, ঘটনার প্রতিরোধে একতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে , দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, বিচারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিচার প্রক্রিয়া আরো তরান্বিত করতে হবে। দেশ মধ্যম আয়ের দিকে গেলেও নারীদের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব আছে। এখানে আরো বরাদ্দ দিতে হবে। সহিংসতার কারণে যে ব্যয় হয় তার দায় নিতে হবে অপরাধীকেও। নীরবতা ভঙ্গের কালচার তৈরির জন্য মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে; জেন্ডার সেনসিটিভ প্যারেন্টিং মডিউল তৈরি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আন্দোলনে পুরুষদের যুক্ত করতে হবে। কেবল আইন করে নয় সকল নাগরিকের জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।নারীদের নেতৃত্ব তৈরির জন্য সুযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে ন্যায়বিচার এখনো নারীবান্ধব নয়। এই সকল প্রতিকূল অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তৃণমূল আন্দোলন অনেক সহায়ক হতে পারে। সংগঠন তৃণমূলে কাজ করছে কয়েক দশক ধরে। এ্যডভোকেসি ও লবি করছে সরকারের সাথে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে মূল দায়িত্ব নিতে হবে, সাথে পরিবারের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। নারীদের আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাসের জায়গা উন্নত করতে হবে। নির্যাতন কে মেনে নেয়ার, সহ্যকরার, আপোষ করার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে নারী আন্দোললনের সাথে যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদের দুটি ধারার উপর সংরক্ষণ রেখেছে এটা প্রত্যাহার করতে হবে, এর জন্য নারীর আন্দোলনেকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বেইজিং ঘোষণা এবং সিডও সনদের পূর্ন বাস্তবায়ন করতে হবে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে। সর্বোপরি গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জায়গা তৈরি হতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন ধর্ষণ একটি পাশবিক অপরাধ। পৃথিবীজুড়ে এটা চলছে। বয়স, অবস্থাগত দিকে থেকে প্রত্যেকেই ঝুঁকিতে আছে। ধর্ষণ কেবল জেন্ডার ইস্যূ নয় বরং সামাজিক ইস্যূ ।এখানে সমাজ, নীতিনির্ধারক, সরকারকে সচেতন হতে হবে, বৃহৎ পরিসরে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।পরিবারে জেন্ডর সমতাপূর্ণ রীতিনীতি চর্চা হতে হবে, প্যারন্টিং কালচাররের সাথে সাথে বৈষম্যমূলক সামাজিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন করতে হবে। নারীর মানবাধিবার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আন্দোলনে সকলকে যুক্ত হতে হবে, আইন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, নারীর প্রতি সহিংসতার কালচার বদলাতে হবে। নারীবান্ধব নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়ন এবং সিডও বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে,১৫ মার্চ ২০২১ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অফ উইমেন (সিএসডব্লিউ) এর ৬৫ তম অধিবেশন শুরু হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এই অধিবেশন চলবে আগামী ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের স্ট্যাটাসভূক্ত সহযোগী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অনলাইনে এই প্যারালাল ইভেন্টির আয়োজন করে। এবারের সিএসডব্লিউ অধিবেশনের মূল থিম জেন্ডার সমতা এবং নারী ও কন্যার ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জনজীবনে নারীর পূর্ণ এবং কার্যকর অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং রিভিউ থিম নারীর ক্ষমতায়ন এবং একে টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে যুক্তকরণ। অধিবেশনে মহিলা পিরষদ অংশগ্রহণ করেছে এবং এর জন্য কেন্দ্র জেলা থেকে মোট ৫৯ জন রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে