‘‘হ্যালো, জেল থেকে আমি নূর হোসেন বলছি”

আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২২
0

‘সাত খুন’ আলোচনায় এলে পুরোভাগে চলে আসে আরেকটি নাম। তিনি নূর হোসেন। ফাঁসির দণ্ড নিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের কনডেম সেলে। তবে এতটুকুও কমেনি তার ক্ষমতার তেজ আর হুঙ্কার।

‘হ্যালো, জেল থেকে আমি নূর হোসেন বলছি।’ ফোনে নূর হোসেনের নাম শুনে প্রথমে ভড়কে যান মুরুব্বি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। আসলেই কি নূর হোসেন? নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! মুরুব্বি মনে মনে ভাবছিলেন, তার তো এখন কারাগারের কনডেম সেলে থাকার কথা, তাহলে কোথা থেকে ফোনে কথা বলছেন। নিজেকে সামলে, ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা কণ্ঠটি নূর হোসেনের নিশ্চিত হয়েই মনোযোগী শ্রোতা বনে যান তিনি।

নূর হোসেন হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘শোনেন, আপনারা আমার ভাই নূর উদ্দিনকে পাস করান। টাকা-পয়সা যা লাগে নেন, কিন্তু নূর উদ্দিনকে পাস করান। যদি না করান তাইলে আমি ২০২৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাইতাছি। তখন কিন্তু কাউরে ছাড়ূম না। যা করার করমু।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের দুটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভাই-ভাতিজাকে জেতাতে কারাগারের কনডেম সেলে বসেই মোবাইল ফোনে বয়োজ্যেষ্ঠদের এভাবেই তালিম দিয়ে যাচ্ছেন এই কয়েদি। আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নাসিক নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন নূর হোসেনের ছোট ভাই নূর উদ্দিন আর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভাতিজা শাহ জালাল বাদল। দু’জনার প্রতীকই ঠেলাগাড়ি। ভোটের মাঠে তাদের দু’জনের পক্ষে নামতেই এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের খুঁজে খুঁজে বের করে এমন বাক্যবাণে ভীতি ছড়াচ্ছেন।

২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নূর হোসেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে প্যানেল মেয়র পদের লড়াইয়ে এক ভোটের ব্যবধানে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাজি ওবায়েদ উল্লাহর কাছে হারেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে নাসিকের প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল বিকেলে লাশ ভেসে উঠলে নূর হোসেন গা-ঢাকা দেন। ওই বছরের মে মাসে তিনি ভারতে পালান। পরে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সাত খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকায় নূর হোসেনকে কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্তও করা হয়।

নূর হোসেন সাত খুন মামলার ফাঁসির দণ্ড পাওয়া প্রধান আসামি। তাকে বর্তমানে রাখা হয়েছে কারাগারের কনডেম সেলে। সাত খুন ছাড়াও নূর হোসেনের নামে বিভিন্ন অভিযোগে আরও ছয়টি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে নারায়ণগঞ্জ আদালতে।

এদিকে জেলে বসেই নিজের সম্রাজ্য ঠিকই অটুট রেখেছেন নূর হোসেন। এলাকার অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন বয়োজ্যেষ্ঠদের ইতোমধ্যে জেল থেকে ফোন দিয়ে ভাই ও ভাতিজার পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কারাগার থেকে তার মতো একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসীর ফোন পেয়ে এলাকার মুরুব্বিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী করবেন, সেটাও বুঝে উঠতে পারছেন না।

কারাগারে বসে নূর হোসেন যাদের ফোন দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হন। তারা জানান, নূর হোসেন তার ছোট ভাই নূর উদ্দিন ও ভাতিজা শাহজালাল বাদলের পক্ষে ভোটের মাঠে নামতে নির্দেশ দিয়েছেন। না নামলে এবং তার ভাই ও ভাতিজা পাস না করলে ২০২৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে তাদের কাছে নূর হোসেনের ফোনগুলো এসেছে। নূর হোসেনের কণ্ঠ শুনেই ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে যেত বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।

এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের অনেকেই জানতে চেয়েছেন এটা কীভাবে সম্ভব? ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামি যিনি কনডেম সেলে আছেন, তিনি কীভাবে জেলে বসে ফোন করেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের একজনের কাছ থেকে নূর হোসেনের সেই কারাগারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন এই প্রতিবেদক। পরে গত মঙ্গলবার রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে সেই নম্বরে ফোন করতেই অন্য প্রান্তে সেটি রিসিভ করেন স্বয়ং নূর হোসেন। কণ্ঠ চিনতে পেরে এই প্রতিবেদক কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। এক সময় নিশ্চিত হন নূর হোসেনই ফোনের অন্য প্রান্তে কথা বলছেন।

এই প্রতিবেদক নূর হোসেনকে জানান, নির্বাচনে তার ভাইয়ের অবস্থান ভালো। তখন নূর হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটের ফল পাওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া যায় না।’ তখন এই প্রতিবেদক বলেন, ‘আপনি ফোন দেওয়ার পর মাঠের চিত্র পাল্টে গেছে।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় ভাইয়ের মধ্যে নূর হোসেন চতুর্থ এবং নূর উদ্দিন পঞ্চম। ভাতিজা বাদল ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনেও কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাত খুনের পর চাচাদের সঙ্গে এলাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়ার পর এবং অভিযোগপত্রে তার নাম না থাকায় তিনি ২০১৫ সালে এলাকায় ফিরে আসেন।

ভাতিজা শাহ জালাল বাদল ও চাচা নূর উদ্দিন উভয়েই একাধিক মামলার আসামি। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া উভয়ের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসএসসি পাস শাহ জালাল বাদলের নামে বিভিন্ন অভিযোগে ৪টি মামলা বিচারাধীন। আরও ৮টি মামলা থেকে খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছেন। আর স্বশিক্ষিত নূর উদ্দিনের নামে বিভিন্ন অভিযোগে ৭টি মামলা বিচারাধীন। দুটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।

৩ নম্বর ওয়ার্ডে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদল তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীদেরও হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১ ডিসেম্বর রাতে বাদলের অনুসারীরা দুই প্রার্থীর কর্মীদের মারধরও করেন।

এ ব্যাপারে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে নূর উদ্দিন বলেন, ‘ভাই আমার ফিল্ড খুবই ভালো। এলাকায় আমার জোয়ার দেখে প্রতিপক্ষরা গুজব ছড়াচ্ছে। এগুলো সত্য নয়।’ অন্যদিকে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদল বলেন, ‘নির্বাচন তো, সবই হচ্ছে রাজনীতি।’

গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে থেকে কীভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া নূর হোসেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার এমএ জলিল বলেন, ‘জেল কোড অনুযায়ী একজন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কয়েদি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তার সবই পান।

সপ্তাহে একদিন টেলিফোনে ১০ মিনিট করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। এ সুযোগ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।’