`তামাকখাতে রাজস্ব আয়ের তুলনায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় সরকারের ব্যয় অনেক বেশি’

আপডেট: আগস্ট ২৮, ২০২৩
0

লেখকঃ ডাঃ নিজামউদ্দীন আহম্মেদ

তামাকের অর্থনীতি জাতীয় প্রবৃদ্ধির নীরব ঘাতক

বাংলাদেশে ধূমপানেরবিরুদ্ধে যে সমস্ত আলোচনা এবং কার্যক্রম চলে তা মূলত স্বাস্থ্যের উপরে তামাকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করে। কিন্তু তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের কারনে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যে বিপুল ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টির অগোচরে থেকে যাচ্ছে। মোটা দাগে স্বাস্থ্যগত ভাবে তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং কার্যক্রম থাকলেও জাতীয় স্বাস্থ্য যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তা আমাদের আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে জাতীয় স্বাস্থ্যে তামাকের করাল গ্রাসের কথা। এই ক্ষেত্রে বিশদ ব্যাখায় না গিয়েও কেবল সংখ্যাতাত্বিক আলোচনার মাধ্যমেও তামাকের কারণে ঘটে চলা ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কথা তুলে ধরা যায়।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি’র ২০১৮ সালের ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অফ টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশঃ আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় মূল নিবন্ধের আলোচনায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা এবং এর কারণে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর ফলে বার্ষিক উৎপাদনশীলতা কমে গিয়েছিল প্রায় ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ফলে এই অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট জিডিপির ১.৪ শতাংশের সমান। ২০১৮ সালের বাজার হিসেবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে তামাকখাতের মোট অবদান ছিলো ২২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে এই খাতে অর্থনৈতিকব্যয় ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা কম। তাহলে পাখির চোখে দেখলেও তামাককে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

এই গবেষনায় পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। এই একই বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগছিলেন এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কেবল তামাক এবং তামাকজাতপণ্য ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪ শ কোটি টাকা, যার ৭৬ শতাংশের খরচ মিটিয়েছে তামাকব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪ শতাংশ খরচ এসেছে জনস্বাস্থ্য খাতের বাজেট থেকে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী ব্যয়ের প্রায় ৯ শতাংশ। এদিকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণার তথ্য মতে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতিবছর নতুন করে ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যতার শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি ৫০ লাখ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে, যার সিংহভাগ হচ্ছে তামাকের মত অসংক্রামক রোগের জন্য।

আবার দেশে তামাক ব্যবহারকারীদের চিত্রও ভয়াবহ। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, বর্তমান দেশে মোট তামাকব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। এই ব্যবহারকারীদের মধ্যে অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী। এসব দরিদ্র মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। ধূমপানজনিত রোগের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসাব্যয় লাখো পরিবারকে প্রতি বছর আর্থিক সংকট ও ভয়াবহ দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যবহারকারী পরিবারগুলো তাদের বার্ষিকআয়ের একটা বড় অংশ তামাকপণ্যের পেছনে ব্যয় করে থাকে।

আবারপ্রান্তিক দরিদ্রব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে তামাকব্যবহারের কারণে মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় তামাক কোম্পানিগুলোর পকেটে। যা পরিবারের আর্থিক সক্ষমতাকে বহুলাংশে দুর্বল করে রাখে।
তামাক দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৪০ হাজার ৪৭২ হেক্টর জমিতে ৮৫ হাজার ৮৫২ টন তামাকপাতা উৎপাদিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতি হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ৯০১ কেজি খাদ্য শস্যের ফলন হয়েছে। তাহলে ২০২০ সালেই ৮৫ হাজার ৮৫২ টন তামাক পাতার পরিবর্তে ২ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৭ টন খাদ্য শস্য উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো মজবুত করা যেত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তথ্য মতে, বান্দরবানের প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত তামাক চাষের ফলে সেখানে খাদ্য সংকট রয়েছে। এসব জমিতে খাদ্যশষ্য চাষ করে এই সংকট দূর করা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি দেশের শীর্ষ দরিদ্র জেলা। বিআইডিএসের তথ্য মতে এসব জেলায় অনেক বেশি পরিমাণে তামাক চাষ হয়। তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষকে লাভজনক হিসেবে প্রচারণা চালালেও দেখা যাচ্ছে তামাক চাষে এগিয়ে থাকা জেলাগুলো দারিদ্র্যের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
তামাক খাত থেকে সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আহরণ করে, তার তুলনায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় সরকারকে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রতিবছরপ্রায় ৩ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তামাকের কারণে। সরকার তামাকের জন্য যে বিপুল ব্যয় প্রতিবছর করে যাচ্ছে তা অন্যান্য খাতে করলে সাধারণ মানুষের জীবনমানে উন্নতি ঘটত এবং একই সঙ্গে তা সাসটেইনএবল ডেভেলমেন্ট গোল -এসডিজি ৩০’র প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য নির্মূল অর্জনে অবদান রাখতেপারত। সব কিছু মিলিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি তামাকের জন্য জাতির বিশাল অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেই সাথে বাংলাদেশ তার কাঙিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে যাচ্ছে।

দেশের আর্থ-সামাজিকএবং স্বাস্থ্য খাতে তামাকের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সরকার ভালভাবেই ওয়াকিবহাল। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের পেছনে যে সরকারী রাদ্দ থাকে, তার বেশিরভাগই চিকিৎসা সেবার পেছনে খরচ করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমরা মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হলেও কিন্তু এখনও দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতি চিকিৎসা সেবা পাওয়ার পর্যাপ্ত নয়। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি লাঘব, তামাকের ব্যবহার কমানো এবং তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্য বাড়ানো এবং তামাক চাষ কমানো। কিন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিসহ যথাযথ আইন ও নীতিমালা প্রণয়নএবং প্রয়োগের পেছনে নজর কম দেওয়া হয়। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসব রোগ ব্যাধি প্রতিরোধ, সুস্থ কর্মক্ষম মানবসম্পদ গঠনে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি আনয়নে তামাকের নাগাল টানা অতীব জরুরী। আর সবচেয়ে জরুরী দরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যুগোপযোগী সংশোধন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন। যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে।

লেখকঃ ডাঃ নিজামউদ্দীন আহম্মেদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
নির্বাহী পরিচালক, স্বাস্থ্য সুরক্ষাফাউন্ডেশন
ভাইস-চেয়ার, গ্যাভিসিএসও স্টিয়ারিং কমিটি

সুত্রঃবাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি’র ২০১৯, স্বাথ্য অর্থনীতিইউনিট ২০২২; বাংলাদেশ উন্নয়নসমীক্ষা; বাংলাদেশে তামাকব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ: একটিপর্যালোচনা; স্বাস্থ্য অর্থনীতিইউনিট; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের-বিআইডিএস;