দুই দশকেও শেষ হয়নি নারায়ণগঞ্জের আ’লীগ অফিসে বোমা হামলার বিচার

আপডেট: জুন ১৬, ২০২১
0

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের বেদনাবিধুর দিন আজ (১৬ জুন)। ২০০১ সালে এই দিনে চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় ২০ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক লোক। চিরতরে পঙ্গুগুত্ববরণ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলার সভাপতি চন্দন শীল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দাসসহ আরও অনেকেই। বোমা হামলার ২০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো মামলার কোনো কুলকিনারা হয়নি। একেক সময়ে একেক তথ্য ও অভিযোগে বদলে যায় মামলার গতিপথ। বিচারের আশায় রয়েছে ২০টি পরিবার।
২০১৩ সালে দেয়া চার্জশিটে ছয়জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি দেয়ার পর দ্রুত গতিতে চলছিল মামলার সাক্ষ্য। কিন্তু গত বছর এমপি শামীম ওসমানের সাক্ষ্য দেয়ার পর সব পাল্টে যায়। মামলার চার্জশিটের বিষয় প্রশ্ন তোলেন তিনি।

মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের পর পরবর্তী দিন আদালত ধার্য করলেও এরই মধ্যে হানা দেয় করোনা। সব মিলিয়ে মামলাটি চলছে খুবই ধীরগতিতে। তবে ২০ বছরে মামলার কুলকিনারা না হওয়ায় বোমা হামলায় নিহতের পরিবারের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘লকডাউনের কারণে বিচার কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। যেদিন থেকে আদালত চালু হবে সেদিন থেকেই বিচার কার্যক্রম চলমান হবে। একইসঙ্গে সাক্ষীদের কাছে সমন জারি করা হবে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রতি সপ্তাহে মামলার তারিখ রাখার জন্য। লকডাউন শেষ হলেই প্রতি সপ্তাহে মামলার তারিখ রাখা হবে। এভাবে চলমান থাকলে আশা করি চলতি বছরেই বিচার কার্যক্রম শেষ হয়ে আসবে।’

শামীম ওসমানের দেয়া সাক্ষীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শামীম ওসমানের বক্তব্য ছিল মামালার মোটিভ সম্পর্কে। মামলার সাক্ষীদের যে রেকর্ড করা হয়েছে সেটা তার কথামতো করা হয়নি। তার বক্তব্যে ছিল ১৬ জুন বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত দুজন পরবর্তীতে দিল্লিতে একইরকম ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছিল। তাদেরকে পরে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর দিল্লীর আদালতে তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছিল শামীম ওসমানকে হত্যার করার জন্যই হামলা করেছিল। কিন্তু আসামিদের এই বক্তব্য চার্জশিটে উল্লেখ করেনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত ছিল দিল্লির পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা।’
গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন শামীম ওসমান। সাক্ষ্য দেয়ার পর আদালত থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘এ মামলায় অনেকের নাম আছে যারা অপরাধী না। যারা প্রকৃত অপরাধী তারা এ মামলা থেকে সেভ হয়ে গেছে। ১৬ জুনের ঘটনায় আমি ছিলাম প্রধান ভিকটিম। প্রধান ভিকটিম হিসেবে আমার যে সাক্ষ্য নেয়া হয়েছিল, আমি দেখলাম তার সঙ্গে ঘটনার কোনো মিল নাই। ঘটনার পরে আমি সাক্ষ্যতে যে জবানবন্দী দিয়েছিলাম এখন দেখি বিচার চলাকালে সেই কথা কিছুই নাই।

আমাদের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। ফলে আমি চাই এ ঘটনায় যারা প্রকৃত দোষী তাদের যেন বিচার হয়।’
শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘আমি আদালতের কাছে অনুরোধ করেছি যিনি মামলা তদন্ত করেছেন তাকে আদালতে তলব করা হোক। আমরা এ মামলার অধিকতর তদন্ত চেয়েছি। যিনি দোষী না তিনি আমার প্রতিপক্ষ হলেও যেন সাজা ভোগ না করে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিকে, পার্টির সাধারণ সম্পাদককে বলেছি আমি এ চার্জশিট মানি না। আমি যদি বেঁচে নাও থাকি এই মামলাটা যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। যারা সত্যিকারের দোষী লোক তাদের যেন বিচার হয় এবং যারা নিরপরাধ সে বিএনপি, জাতীয় পার্টি যাই করুক তাদের যেন কোনো বিচার না হয়। তাহলে সাজাপ্রাপ্ত হবে সংবিধান, সাজাপ্রাপ্ত হবে আইন, সাজাপ্রাপ্ত হবে আমাদের বিবেক, আমাদের ঈমান।’
এদিকে, চাষাড়া বোমা হামলার ঘটনায় খোকন সাহা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় দুটি মামলায় (একটি বিস্ফোরক অন্যটি হত্যা) জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তৈমুর আলম খন্দকারকে প্রধান করে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের মোট ২৭ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার দীর্ঘ ২২ মাস পর ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে বোমা ট্রাজেডি মামলা দুটির ফাইনাল রিপোর্টে মিলে অবাক করা তথ্য।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাড়া আওয়ামীলীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তবে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঘটনায় নিহত চা দোকানি হালিমা বেগমের ছেলে আবুল কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান, তার ভাই নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৫৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন। উচ্চ আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেন।
দীর্ঘ ছয় বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে মামলাটি নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারকে আদেশ দেন। ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলার ১২ বছর ছয়জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি দিয়ে দুটি মামলাতেই নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯৪৭ পাতার পৃথক দুটি চার্জশিটটি দাখিল করা হয়। তবে উভয় মামলাতেই অভিযুক্ত ও অব্যাহতিপ্রাপ্তরা ছিল অভিন্ন।

চার্জশিটে অভিযুক্ত ছয়জন হলেন নারায়ণগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিডের ভোট ভাই শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান (এরইমধ্যে অপর এক মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত), জঙ্গি নেতা ওবায়দুল্লাহ রহমান, ভারতের দিল্লি কারাগারে আটক সহোদর আনিসুল মোরসালিন, মুহিবুল মুত্তাকিন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এর ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু। বর্তমানে তিনি ওসমান পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা রেখে দলীয়সহ জনপ্রতিনিধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে সাক্ষ্য প্রদানের সময়ে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনায় চার্জশিটভুক্ত আসামি মহানগর বিএনপির নেতা ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু, চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ‘জড়িত মনে করেন না’ ওই ঘটনায় আহত এমপি শামীম ওসমান।

যারা নিহত হন : সেদিন নিহত হয়েছিলেন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক মহিলা।
হামলায় শামীম ওসমান সহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। তার ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীল, যুবলীগ কর্মী রতন দাস দুই পা হারিয়ে চিরতরে বরণ করেছে পঙ্গুগুত্ব।

কী ঘটেছিল সেইদিন : প্রতি শনিবার ও সোমবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এমপি শামীম ওসমান। ২০০১ সালের ১৬ জুন ছিল সোমবার। সেদিন বিকেলের পর থেকেই চাষাড়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে জড়ো হতে থাকেন লোকজন। সবার উদ্দেশ্যে ছিল শামীম ওসমানের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু তখনো কেউ বুঝতে পারেনি সামনে অপেক্ষা করছে যমদূত। রাতে যখন একে একে শামীম ওসমান লোকজনদের সাক্ষাৎ দিচ্ছিলেন তখনই ঘটে বিস্ফোরণ।
চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে নৃশংস বোমা হামলা নিহত ২০টি পরিবারের স্বজনদের কান্না আজও থামেনি। আজও কেঁদে ফিরছে ২০টি পরিবার। স্বজন হত্যাকারীদের বিচার পাননি তারা। ভবিষ্যতেও পাবে কিনা তাও জানে না হতভাগ্য এ পরিবারগুলো। উপার্জনক্ষম একমাত্র সদস্যকে হারিয়ে আর্থিক দৈন্যদশায় জর্জরিত অনেক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এত কষ্টের মধ্যেও তাদের একটি দাবি, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা হোক।

২০০১ সালের ১৬ জুন বিকেলে স্ত্রী আর ভাই বোনদের সঙ্গে চা খেয়েছিলেন সহোদর দুই ভাই সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও তার ভাই সংগীত শিল্পী মোশারফ হোসেন মসু। রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথাও বলেছিলেন তারা। তারা ফিরেছিলেন ঠিকই কিন্তু লাশ হয়ে।
বোমা হামলায় নিহত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা ঘটনার দিন ব্যাংকে একটি চাকরি তদবির করতে গিয়েছিলেন শামীম ওসমানের কাছে। চাকরি হলে সংসারটি বেশ ভালোভাবে চলবে এমন প্রত্যাশাও সবার। কিন্তু সেই প্রত্যাশা আর পূরণ না হওয়ায় বর্তমানে বেশ টানাপড়েন অবস্থা চলছে সবুজের পরিবারে।

বিকেলে অসুস্থ স্বামীর পা ব্যান্ডেজ করে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ফতুল্লা থানা মহিলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পলি বেগম। কিন্তু বোমা কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। তিন সন্তানদের মধ্যে এক ছেলে আর এক মেয়ে এলাকাতে একটি টেইলার্স দিয়ে কোনোভাবে সংসারের হাল টানছেন। বিকেলে শিশু মেয়ের জন্য কোনো ব্র্যান্ডের দুধ আনতে হবে তা স্ত্রী আনোয়ারার কাছ থেকে জেনে নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে যান মো. হানিফ নূরী। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। শিশু কন্যার খাবার আনতে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো এক কারণে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে তিনি বর্বরোচিত বোমা হামলার শিকার হন। পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে অসহায় পরিবারটি আজ দুই চোখে অন্ধকার দেখছে। চরম হতাশার মধ্যে তারা হাবুডুবু খাচ্ছে।
শওকত হোসেন মুক্তার একজন ভালো সাহিত্যিক ছিলেন। ১৬ জুন একটি বিশেষ কাজে বাবুরাইলের বাসা থেকে বেরিয়ে চলে যান চাষাড়া আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। বোমা হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেতা ও সংগীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চুর তিন সন্তান নিয়ে স্ত্রী চরম অর্থকষ্টে রয়েছেন। একসময়ের সচ্ছল এই পরিবারটি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে চরম সঙ্কটে পড়েছেন। অন্যান্য পরিবারগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

সেদিন বোমা হামলায় দুই পা হারানো রতন কুমার দাস বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহের শনি ও সোমবার সাধারণ মানুষের কথা শুনতেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সভার শেষ মুহূর্তে পায়ের একটু সামনে প্রচন্ড বিস্ফোরণ। চোখের সামনে আগুনের গোলা। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কোমরের নিচ থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল ক্লাবের সামনে। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। নিথর দেহের পাশে আহতদের গোঙানির শব্দ যেন মৃত্যুপুরী।’