ফিরে ফিরে আসে সে শিশির নীড়ে নাহিয়া

আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০২১
0
file photo

ফিরে ফিরে আসে সে শিশির নীড়ে নাহিয়া । নীড় বাঁধা পাখিরা এনেছে স্বর্গের আভাস। গেয়ে যায় সুরলোকের গান। সবুজ পাতায় হলুদেরা দিয়ে যায় ছোঁয়া। এমনি করেই বিভিন্ন ছন্দে-পদ্যে হেমন্ত ঋতু অনবদ্য ও নান্দনিকতায় বাংলা কাব্য সম্ভারকে বিশাল বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত করেছে। নদী, নারী ও হেমন্তের উদাসীন-উৎফুল্ল প্রকৃতি বারবার উঠে এসেছে আমাদের বাংলা কাব্য ও চিত্রকলায়।


বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণের ‘চর্যাপদে’ বিশেষ কোনো ঋতুর উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। শুধু কাউন বা চিনা পাকার মাস অর্থাৎ শীতকালের উল্লেখ রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে মধ্যযুগের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের সামান্য নমুনা পাওয়া যায়। কবি বলেন, ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ/যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’।

সব ঋতু নিয়েই এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরা পেয়ে থাকেন কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। কবিরা আমাদের এই বৈচিত্র্যময় ঋতুকে তুলে ধরেন মধুময় কাব্য-অলঙ্কারে, সুন্দর-সাবলীল সাহিত্যে। প্রায় সব কালের, সব কবির রচনায় কোনো না কোনোভাবে হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে।


জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় হেমন্তের দেখা মেলে। ‘হেমন্তের কবি জীবনান্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই।

হেমন্তের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কখনো এত সুন্দর ও ভয়ঙ্কর অনুভূত হয় যে তখন মানবমনে প্রকৃতি নারী রুপ হয়ে ধরা দেয়। আল মাহমুদের (জ.১৯৩৬) কবিতায় প্রেম প্রকৃতি সৌন্দর্য ও নারী অভিন্ন সত্তায় একাকার হয়ে মিশে আছে।

‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে

আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে

রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে

আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর

বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো। ‘

কত কবির কত কবিতা, কত শিল্পীর কত গান এই হেমন্ত নিয়ে। আমরা প্রাণিত হই বাংলার রূপ বর্ণনার কাব্য ও গানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তের নাম দিয়েছেন শস্যলক্ষ্মী। শস্যলক্ষ্মী হেমন্ত সুখ,সমৃদ্ধি ও অমৃতের সুধা ঢেলে দিয়ে লাজুক বধুর মতো শীতের কুয়াশায় ঘোমটা টেনে বিদায় গ্রহণ করে। তাইতো, কবি সুফিয়া কামাল হেমন্তকে চিঠি লিখে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আবির্ভূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

শরতে আসে ফসল বোনার যৌবন, হেমন্তে ঘটে তাঁদের গৃহ-বরণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূর্ণতা নিয়ে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল লাল রায় লিখেছেন,

‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’।

কবির কল্পনাতে এই বসুন্ধরা যেন হেমন্তের বাংলা। কারণ, হেমন্তে ধন–ধান্যে পুষ্পে ভরে উঠে বাংলার প্রতিটি আঙিনা। মনে হয় হেমন্ত যেন নব বধূর ঘোমটা টেনে ফসলের ডালি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বাংলার প্রতি গৃহে, প্রতি আঙিনায়। বাঙালি মাত্রই মুগ্ধতায় মোহিত হয়ে উঠে ফসলের গন্ধে৷ হেমন্তের ফসলভরা মাঠে মোহিত হয়ে কবিগুরু তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় সঙ্গীতে।

‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি/ আমি কী দেখেছি মধুর হাসি সোনার বাংলা…।’

হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার ‘নক্সীকাথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের “সুখের বাসর” কবিতায়।

‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু

কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’

হেমন্তকালের মূল আকর্ষণ নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসব আবহমানকাল বাংলার ঐতিহ্য। ঘরে ঘরে চলে ফসল কাটার উৎসব। নতুন ধানের চালের পিঠা যেন শীতের আমেজ নিয়ে আসে।

‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান।‘

সংগৃহিত