“শেখ হাসিনার তৈরি গণশত্রুর খোঁয়াড়ে ঢুকছেন কারা”

আপডেট: জানুয়ারি ২, ২০২৪
0

অলিউল্লাহ নোমান

শেখ হাসিনার বানানো গণশত্রুর খোঁয়াড়ে ঢুকতে শেষ মুহূর্তের প্রতিযোগিতা ও মান অভিমান এখনো চলছে। কিংস পার্টিখ্যাতি তৃণমূল বিএনপি’র তালিকায় নাম উঠানো গণশত্রুদের মান অভিমান ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ২৯ ডিসেম্বর তৃণমূলের মনোনীত প্রার্থীরা ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি প্রকাশ্য সভা করেছে। এতে তারা বিষোদগার করেছেন তৃণমূলের সভাপতি শমসের মোবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের সব প্রার্থীর সাথে মতবিনিময় ও আলোচনা সভা শিরোনামে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে শমসের-তৈমূরকে জাতীয় বেঈমান বলে আখ্যায়িত করেছেন দলটির প্রার্থীরা। তাদের কথার সুর অনুযায়ী যতটুকু বুঝা গেছে, মোটাদাগে টাকা দেওয়ার কথা ছিল প্রার্থীদের। কিন্তু তারা কাঙ্ক্ষিত সেই টাকা পাননি। না পাওয়ার বেদনা থেকে দলটির সভাপতি ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন তারা। নিজেরা যে ইতোমধ্যেই গণশত্রুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন সেটা ভুলেই গেছেন। তাদের লক্ষ্য দেশ ও জনগণ নয়। টাকা অথবা শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে প্রবেশ করা।

এদিকে ৩০০ আসনে গণশত্রুর তালিকায় কারা চূড়ান্ত হচ্ছেন সেটা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে সবকিছু। তফসিলের পরপরই যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে ভোটের অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক সেনা অফিসার সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম। তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তিনি এবার শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে ঢুকছেন। তিনি যে আসন থেকে নির্বাচন করছেন সেই আসেনের অন্তর্ভুক্ত ইউপি ও পৌর চেয়ারম্যানরা একজোট হয়ে নির্বাচন কমিশনে একটি চিঠি দিয়েছেন। এই চিঠিতে তারা প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে জেনারেল ইব্রাহিমের পক্ষে ভোট করার জন্য। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। স্বতন্ত্র হিসাবে বর্তমান এমপি নির্বাচন করছেন। তবে ডিজিএফআই’র চাপ হচ্ছে সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের পক্ষে।

শমসের মোবিনের আসনে এখন আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন। রবিবার রাতে প্রকাশিত পত্রিকা গুলো অনলাইন নিউজে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এখন প্রকাশ্যেই শমসের মোবিনের পক্ষে। যদিও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক এবং আরেকজন স্বতন্ত্র রয়েছেন। তারপরও উপরের নির্দেশে দলটির স্থানীয় নেতারা এখন শমসের মোবিনের তৃণমূলের পক্ষে। তৈমূর আলমের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

এদিকে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মেজর অব: আখতারের পক্ষে রবিবার প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ। তিনি সাবেক আইজি। ২০০৮ সালে জরুরী আইনের সরকারের নির্বাচনে বিজয়ী হতে সহযোগিতার পুরস্কার হিসাবে দ্বিতীয় পদক ছিল নৌকা প্রতীক। ২০১৮ সালের সাজানো নির্বাচনে তাঁকে নৌকা দিয়ে দ্বিতীয়বার পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। এর আগে তাঁকে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এবার নুর মোহাম্মদকে নৌকা দেওয়া হয়নি। নৌকা দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার আরেক বিশ্বস্ত আবদুল কাহহার আকন্দকে। নুর মোহাম্মদ প্রকাশ্যে আসায় এই আসনটি নিয়ে মেজর আখতারুজ্জামানই শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে ঢুকবেন এমন প্রত্যাশা এখন তাঁর।

চট্টগ্রামের একটি আসনে নৌকার প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন মাইজভাণ্ডারীর পক্ষে মাঠে আওয়ামী লীগ। উপরের নির্দেশে তারা নৌকা ডুবিয়ে সুপ্রিম পার্টির পক্ষে মাঠে। কারণ, ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে তালিকাভুক্ত চুড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছে সাঈফুদ্দিন মাইজভাণ্ডারী। এই আসনটি আগের দু’টি নির্বাচনে শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছিলেন তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল হক মাইজ ভাণ্ডারীকে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন নজিবুল হক মাইজভাণ্ডারী। পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপিতে। ১৯৯৬ সালে ধানের শীষ নিয়ে পরাজিত হন এই আসনে নজিবুল হক মাইজ ভাণ্ডারী। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। নির্যাতনেরও অভিযোগ তোলা হয়েছিল নজিবুল হক মাইজভাণ্ডারীর পক্ষ থেকে। কিন্তু ২০০১ সালের আগেই তিনি আবার বিএনপি ত্যাগ করেন। গঠন করেন তরিকত ফেডারেশন। শেখ হাসিনা ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালে তাঁর আসনটি উপহার দিয়েছিলেন।

প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে জাতীয় পার্টির ২৬টি এবং তথাকথিত মহাজোটের শরীক দল গুলোকে আরো ৬টি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে এই ৩২ আসন নির্বাচনের আগেই তাদের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে।

এদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ অনুগত আরো একাধিক পীর মাশায়েখকে খোঁয়াড়ে ঢোকানে হবে, এমনটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

৭ জানুয়ারী ভোটের দিন কাদের নাম বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করা হবে তাঁর একটা বাতাস মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে। গণতন্ত্রের ফ্যাসিবাদী স্টাইল শেখ হাসিনা বাংলাদেশে চর্চা করছেন ২০১৪ সাল থেকে। এই স্টাইলে রাষ্ট্রীয় টাকা খরচ করে ভোটের আয়োজন করা হয়। কিন্তু, কারা বিজয়ী হবেন সেটা ঠিক করে দেন শেখ হাসিনা নিজে। যেমন, ২০১৪ সালে ভোটের আগেই শেখ হাসিনার ইচ্ছায় ১৫৪ আসনে বিজয়ীর তালিকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ভিন্ন স্টাইলে বিজয়ীদের নাম চুড়ান্ত করেছেন শেখ হাসিনা। এখন তাঁর দলের লোকজনই প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বলছেন ২০১৮ সালে ভোটের আগের দিন বিকালে তাদের কাছে মেসেজ আসে ৬০ শতাংশ ব্যালটে সীল মেরে রাখতে। শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী স্টাইলে ভোটের নামে তামাশার আয়োজন করেও নির্বিঘ্নে ৫ বছর কাটিয়েছেন। তেমন কোন বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখে তাঁকে পড়তে হয়নি বিরোধী দল ও জোটের পক্ষ থেকে।

বিরোধী দল গুলো নির্বাচন বর্জন করায় শেখ হাসিনা এবার ভিন্ন স্টাইল হাজির করেছেন। এবারের স্টাইলটি হলো ডামি প্রার্থীর নির্বাচন। কোন আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়। ডামি প্রার্থী রাখার জন্য শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতাদের। ডামি প্রার্থী স্টাইল নির্বাচনে এখন বিজয়ীদের নাম চুড়ান্ত করছেন শেখ হাসিনা। ৭ জানুয়ারী একটি আনুষ্ঠানিকতা হবে মাত্র। এরমধ্যে দুই/চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও ঢোকানো হবে তাঁর খোঁয়াড়ে। মূলত জাতীয় সংসদ ভবনটি ২০১৪ সাল থেকে শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে রূপ নিয়েছেন। এই খোঁয়াড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন গণশত্রুরা। দেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে যারা শেখ হাসিনার খোঁয়াড়ে প্রবেশ করেন তারা মূলত: গণশত্রু। পুরো দেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গঠন করা হচ্ছে এই সংসদ। সার্বভৌমত্বকে দিল্লীর কাছে বিকিয়ে দিয়ে গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় মসনদ ধরে রাখতেই গঠন করা হচ্ছে এই সংসদ। ভারতপন্থী এই গণশত্রুদের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়াবে এবং একদিন বিচারের মুখোমুখি তাদেরও হতে হবে।

লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক