`শ্রাবণের ধারা আর সোহাগী রোদ্দুরের পেলব স্পর্শে প্রকৃতির যৌবনে এসেছে পূর্ণতা’

আপডেট: জুলাই ১৪, ২০২৩
0

অঝোর শ্রাবণের ধারা আর সোহাগী রোদ্দুরের পেলব স্পর্শে শরাবতীর যৌবনে এসেছে পূর্ণতা।
নবধারা জলে এবার বর্ষার রেশ ধরে নিয়েছে শ্রাবণ। কবি নজরুলের ভাষায়-
এ ঘোর শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে
হায়, রহি রহি সেই মুখ পড়িছে মনে॥
বিজলিতে সেই আঁখি
চমকিছে থাকি থাকি,
শিহরাতো এমনি সে বাহু-বাঁধনে॥
কদম-কেশরে ঝরে তারি স্মৃতি,
ঝর ঝর বারি যেন তারি গীতি।
হায় অভিমানি হায় পথচারী,
ফিরে এসো ফিরে এসো তব ভবনে॥
প্রকৃতি সাজে তুলির শেষ আঁচড় পড়ে শ্রাবণে। হাওর-বাওড়-নদী-পুকুর জলে হয় টইটুম্বুর। দিগন্তজোড়া সাদা-কালো মেঘের ছায়া জলকে করে বিবর্ণ করে তোলে তাদের রঙে। সবুজে প্রাণফেরা গাছগাছালি সবুজ থেকে হয় গাঢ় সবুজ। চোখকে দেয় নতুন প্রশান্তি।
বর্ষাবন্দনার পথপ্রসারি কবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে বর্ষায় শ্রাবণরাগ বর্ণনা করেচে এভাবে
‘প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?
যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’

প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী তার এক কাব্যে শ্রাবণবন্দনা করেছেন,
‘সখি, নব শ্রাবণ মাস
জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা
ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ!
ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,
মুর্হুমুর্হু দামিনী-আভাস!
পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি
দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস।’

আকাশে বৃষ্টি আসুক গাছেরা উঠুক কেঁপে ঝড়ে … এমন সুরে রিমঝিম তালের মিষ্টি সুরের শ্রাবণ। নদী তীরে মেঘ মাদলের পাল তুলে এসেছে শ্রাবণের তরী। এনে দিয়েছে রোমান্টিকতা। আকাশে সূর্যালোকের অল্পবিস্তর বিচ্ছুরণে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভেসে ওঠে রংধনু। মেঘের নাচনে বর্ষার যে কত ব্যঞ্জনা …!

বৃষ্টিতে মানব হৃদয়ের ভাবাবেগ অতি দ্রুত ছুটে ব্যাকুল করে দেয়। বৃষ্টির নুপুরের ধ্বনিতে দূরে ও কাছে মুখোমুখি বসে থাকে দু’ জনা। অনুভবে কাছে পায়। হৃদয় দিয়েই হৃদয়ের কাছে চলে যাওয়া। এর মধ্যেই মনের ভাষায় অব্যক্ত কথাগুলোও বলা হয়। বর্ষায় মানুষ ও প্রকৃতিও যেন একাকার হয়ে যায় এমন মধুময়তায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। বৈষ্ণব কবিরা বলেছেন বর্ষাভিসার। কত কথা বর্ষাকে নিয়ে। হলুদ বরণ গায়ক দল হেড়ে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তোলে। মন্দ লাগে না।

বর্ষার সুরকে রবীন্দ্রনাথ হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করার এবং ভাবের যে ব্যকুলতা তুলে এনেছেন অন্য কেউ তা পারেনি। বর্ষার কবিতার ছন্দ হার মানায় আর সব ছন্দকে। যেমন তিনি লিখেছেন ‘ওই আসে অতি ভৈরব হরষে/ জল সিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভভরসে/ ঘর গৌরবে নব যৌবনা বরষা/ শ্যামগম্ভীর সরসা।

গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে, উতলা কলাপী কেকা কলরবে বিহরে- নিখিলচিত্তহরষা/ ঘন গৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।’ শ্রাবণের মেঘ ও বৃষ্টি উতল ধারার বাদল বরিষণ মানব জীবনে এক বিপুল বিস্ময় ও আনন্দ বেদনার ভুবনে পৌঁছে দেয়। এমনই ধারায় কবিগুরু কবিতায় জানান দেন ‘আজি ঝরের রাতে তোমার অভিসার/ পরান সখা বন্ধু হে আমার।

আকাশ কাঁদে হতাশসম, নাই যে ঘুম নয়নে মম- দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বারে’। বর্ষার ঝড় ও বারিধারা রাতে প্রনয়ের মানবীকে হৃদয় মাঝে পাওয়া যায়। শ্রাবণের আকাশ যেন নানা বর্ণে নানা ধারায় অব্যক্ত কথাগুলো তুলে ধরে। আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্ণের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেক পারেই রংধনু। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। গ্রামের ঝাউবনে, বাঁশ বাগানে, নদী তীরে চর এলাকায় বর্ষায় বেশি ফোটে নাম না জানা কত বনফুল। যা দৃষ্টিতে এসে মন রাঙ্গিয়ে দেয়। শ্রাবণের ধারায় এই ফুলগুলো নেচে ওঠে। প্রকৃতি নিয়ে যত গান রচিত হয়েছে তার মধ্যে বরষা এগিয়ে। উপমহাদেশের বড় শিল্পীরা বর্ষাকেই আবেগের সুরে টেনে এনেছেন বেশি। হেমন্তের কণ্ঠে ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ …।’

সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয় সেদিন তাহার সঙ্গে করো পরিচয়… ।’ মান্না দের কণ্ঠে “ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে..যদি সে আসতে চেয়েও আসিতে না পারে.. এলে না হয় ঝরো ওগো অঝর ধারায় যদি সে যেতে চেয়েও যেতে নাহি পারে … ।’

বর্ষার গানের মূলে আছে মানব মানবীর হৃদয়ের আকুলতা। প্রকৃতি এভাবেই মানুষকে কাছে টেনে আনে। বর্ষার কাব্য ধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ী দাস মেঘ বৃষ্টির অনুসঙ্গে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতাকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও এগিয়ে গিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন অন্তরঙ্গ রঙে। সেই রঙের ধারাতেই হয় তো এসেছে রংধনু। রংধনুর কয়টি রং এ নিয়ে বিতর্ক সেই আদিকাল হতে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা- রংধনু সৃষ্টি হয় পানির ফোঁটায় সূর্যালোকে। বৃষ্টির কনা জলীয় বাষ্প মিশ্রিত বাতাসের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো যাওয়ার সময় আলোর প্রতিসরণে বর্ণালীর সৃষ্টি

। বর্ণালীর ভাগ হয়ে যায় কয়েকটি রঙে। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আকাশে নেতিয়ে পড়ে। দেশে দেশে শিল্পীরা রংধনু নিয়ে ছবি এঁকেছেন গান গেয়েছেন কবিতা লিখেছেন। রংধনুর এমন দৃশ্যপটের মধ্যে বর্ষায় নদ নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। কখনও রুদ্ররূপ ধারণ করে। নদী তীরের মানুষ জেগে ওঠে নিজেদের রক্ষায়। ভালবাসার বন্ধনে একাকার হয়ে যায় মানুষ। মাঝিরা নৌকায় জাল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে চলে যায় নদীতে। শ্রাবণে পাল তোলা নৌকা নদী বয়ে দূরের যাত্রায়। বর্ষার এমন ধারার মধ্যে মানুষ খুঁজে নেয় জীবনের অর্থ। এমন জীবনেই মানুষের পথ চলা …।

লেখা সংগৃহিত